-->

ভবিষ্যৎ সম্পর্কীয় একটি মু’জিযা


এই কথাগুলো লিখছি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ / ১৪২৬ বাংলা/ ১৪৪০ হিজরি সালের কোন এক সকালে এই মুহূর্তে কি কেউ বলতে পারবে ২০২৯ খ্রিষ্টাব্দ / ১৪৩৬ বাংলা/ ১৪৫০ হিজরি সালের বিশ্ব পরিস্থিতি কেমন থাকবে ? এক কথায় এর উত্তর না এবং এই না এর ব্যাপারে আস্তিক-নাস্তিক, জ্ঞানী-মূর্খ অর্থাৎ গোটা বিশ্বের সবাই একমত কেনএই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিশ্বজাহানের একমাত্র রব মহান আল্লাহ্পাক, নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ -- তাঁর কাছেই রয়েছে ঘড়িঘন্টার জ্ঞান, আর তিনি বর্ষণ করেন বৃষ্টি, আর তিনি জানেন কি আছে জরায়ুর ভেতরে আর কোনো সত্ত্বা জানে না কী সে অর্জন করবে আগামীকাল আর কোনো সত্ত্বা জানে না কোন দেশে সে মারা যাবে নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ সর্বজ্ঞাতা, পূর্ণ-ওয়াকিফহাল” [সুরাহ লুকমান ; আয়াত নং ৩৩]



সর্বজ্ঞানী সেই মহান আল্লাহ্পাক মানবজাতির উপকারের জন্য ভবিষ্যতের কিছু কথা তার প্রিয় নবী-রাসুলদের মাধ্যমে আমাদিগকে জানিয়ে দিয়েছেন অতএব, ঐ কথাগুলো সম্পূর্ণ নির্ভুল সুতরাং মৃতকে জীবিত করা যেমন নবীর মুযিযা, ঠিক তেমনি নবীর এই ভবিষ্যৎ বানীগুলোও মুজিযা এই অগণিত মুজিযার ভাণ্ডার থেকে একটি এখানে উল্লেখ করছি                                                                         


হযরত হুযাইফা রা. থেকে নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়েছেরাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন তোমাদের দ্বীনের শুরু নবুওয়াত ও রহমত এর মাধ্যমে এবং তা ততদিন থাকবে যতদিন আল্লাহ চাইবেন। তারপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নিবেন। এরপর আসবে নবুওয়াতের আদলে খেলাফত। তাও ততদিন থাকবে যতদিন আল্লাহ চাইবেন। তারপর মহান আল্লাহ তা উঠিয়ে নিবেন। এরপর আসবে দুষ্ট রাজতন্ত্রের যমানা। আল্লাহ যতদিন ইচ্ছা তা রাখবেন, তারপর আল্লাহ তাও উঠিয়ে নিবেন। এরপর আসবে স্বৈরতন্ত্রের যমানা এবং তা ততদিন থাকবে যতদিন আল্লাহ চাইবেন। তারপর আল্লাহ তাও উঠিয়ে নিবেন। এরপর আবার আসবে নবুওয়াতের আদলে খিলাফত। [মুসনাদে আহমাদ-৪/২৭৩, মুসনাদে বাযযার-৭/২২৩, তাবরানী- ৬/৩৪৫] ।                                                  

লক্ষ্য করুন, এই হাদিসে ৩টি ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে। যথাঃ (১) খিলাফাতের সময়সীমা ; (২) খিলাফাত, রাজতন্ত্র ইত্যাদির ক্রম ধারা ; (৩) খিলাফাতের পুনঃ আবির্ভাব। এবারে এই হাদিসটিকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা যাক                                                                                   
রাসুলুল্লাহ যখন এই কথাগুলো বলেন, তখন তিনি জীবিত অতঃপর কোন এক সময়ে (১১শ হিজরি) তিনি ইন্তেকাল করেন অর্থাৎ নবুওয়াতের যমানা শেষ হল হযরত আবুবকর সিদ্দিক(রাঃ) খলীফা নির্বাচিত হলেন শুরু হল খিলাফাতের যমানা। উক্ত হাদিস মতে এই খিলাফাত মাত্র ৩০ বৎসর স্থায়ী হওয়ার কথা !

এবার আমরা ইতিহাস খুলে দেখি কি তথ্য মেলে ! আমরা একে একে ৫ জনকে খলীফা নির্বাচিত হতে দেখি। ৫ম খলিফার পরে হযরত মুয়াবিয়া(রাঃ)-র মাধ্যমে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নিচের ছকটি দেখুন।

 হাদিসটির ভাষ্যে এটা খুবই সহজবোধ্য যে বর্ণিত ভবিষ্যৎবাণীটি করা হয়েছিল ইসলামী দেশগুলো সম্বন্ধেকারণ গাইরে-ইসলামী দেশগুলোতে কখনো খেলাফত চালু হয়নি। অতএব, এই হাদিসের আলোকে আমরা মুসলিম বিশ্বের প্রেক্ষাপটে খেলাফত পরবর্তী পরিস্থিতির কিঞ্চিৎ ব্যবচ্ছেদ করব। 
                                           
মহান সাহাবী হযরত মুয়াবিয়া(রাঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র মুসলিম বিশ্বে ১৯২৪ পর্যন্ত টিকে ছিল। তবে আব্বাসিদের উত্থানের পর থেকে মুসলিম বিশ্ব একাধিক রাজবংশের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে একই সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন রাজবংশের কর্তৃত্ব পরিলক্ষিত হয়। এ সকল রাজারা ছিলেন ভালমন্দের মিশ্রণ। এদের মধ্যে যেমন ছিল সুলতান মাহমুদ, ইউসুফ বিন তাসফীন, হারুনুর রশিদ, সালাহউদ্দিন আইয়ুবি, রুকুনুদ্দিন বাইবার্স, শেরশাহ ও আওরঙ্গজেবের মত ব্যক্তিত্ব, তেমন ছিল ইয়াজিদ, সুলাইমান বিন আব্দুল মালিক, আল-মুসতাসিম বিল্লাহ আর আবু আবদুল্লাহর(গ্রানাডা) মত অযোগ্য ও জঘন্য কিছু শাসক। তবে সার্বিক বিচারে, বাদশাহ আকবরের মত ২-৩ জন বাদে বাকিরা, নিজেদের বক্তিগত চরিত্র যেমনই হোক না কেন দ্বীন-ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। এ কারণে সর্বত্র শরীয়ত মোতাবেক আর্থিক-বিচারিক-প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। এমনকি মুসলিম উম্মাহর অখণ্ডতার ও শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি যে খিলাফাত ব্যবস্থা, এ বিষয়টিও তারা স্বীকার করত। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকেই তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে খিলাফাত বলে পরিচয় দিত। এ কারণেই ১ম উসমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত উসমানিয়া রাজতন্ত্র উসমানী খিলাফাত নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং ১৯২৪ সালে যখন এই বংশের পতন ঘটে, তখন উহা মুসলিম বিশ্বে খিলাফতের পতন বলে প্রচারিত হয়। অথচ খিলাফতের প্রকৃত পতন সেই ৪১ হিজরি তথা ৬৬১ খৃষ্টাব্দেই ঘটেছিল।

বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোতে বহু ধরণের শাসনব্যবস্থা চালু আছে,  কোথাও রাজতন্ত্র (যেমন সৌদি আরব), কোথাও পশ্চিমা গণতন্ত্র (যেমন পাকিস্তান), কোথাও সমাজতন্ত্র (যেমন সিরিয়া) ইত্যাদিতবে যে সুরতেই থাকুক না কেন, আসলে ওদের প্রত্যেকটি কম-বেশ একনায়কতন্ত্র বৈ অন্য কিছু নয়। আর একনায়কতন্ত্র মানেই এক ধরণের স্বৈরতন্ত্র। অর্থাৎ ১৪৪০ হিজরি পর্যন্ত আমরা হাদিসের ভবিষ্যৎবাণী বাস্তবায়িত হতে দেখছি।  অতএব, আমরা নিশ্চিন্তে বলতে পারি যে, হাদিসটির শেষ অংশ অর্থাৎ পুনরায় নবুওয়াতের আদলে খিলাফাত ধরায় আবার আসবে, তবে আল্লাহ্যখন চাইবেন ক্ষমতাসীন স্বৈরাচাররা যে এই ব্যাপারে সর্বাত্মক বাঁধা দেবে, এতে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু তাঁর চেয়েও সন্দেহাতীত বিষয় হচ্ছে এটি ঘটবেই ঘটবে কারণ এটা যে বিশ্বনবীর বাণী, যে মুজিযা ! ফেরাউন যেমন মুসা(আঃ)-এর আগমন ঠেকাতে পারেনি, তেমনি রাসুলুল্লাহ -এর ভবিষ্যৎ বানীকেও কেউ রদ করতে পারবে না। কিন্তু এই ভবিষ্যৎবাণী ফলবে কখন ? কোথায় ? কিভাবে ? যদিও মনে হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু আসলে এটি একটি অবান্তর আলোচনা। হাদিসের ভাষ্যে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, স্বৈরতন্ত্রকে মহান আল্লাহ্‌ পাক উঠিয়ে নেবেন আর আল্লাহ্‌ পাক মহাপরাক্রমশালী এবং সর্বশক্তিমান। তাঁর  ফয়সালাকে কেহই আটকাতে পারে না।                                                                               
এখানে যে সূক্ষ্ম প্রশ্নটি উদিত হয়, উহা হল, এই খিলাফাত প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানরা কতটুকু মেহনত করবে ? প্রথমেই বুঝে নেয়া দরকার যে, খিলাফাতের ভিত্তি হল নবুওয়াত। এটা সত্য যে আর কোন নবী দুনিয়াতে আসবেন না (কিয়ামাতের আগে হজরত ঈসা আলাইহিস-সালামের আগমন নবী হিসাবে নয়, বিশ্বনবী(সাঃ)র উম্মত হিসাবে হবে)। কিন্তু তাই বলে নবীদের mission and vision থেমে থাকতে পারে না কারণ বিশ্বনবী(সাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে তাঁর উম্মতের জন্য এটা বাধ্যতামূলক করে গেছেন, আমার তরফ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দিও। আর নবুওয়াতি কার্যপদ্ধতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষের অন্তরে আল্লাহ্‌-ভীতি এবং পরকালে জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত করা। যখন সার্বিকভাবে এ দুটো বিষয়ের ব্যাপ্তি ঘটবে, তখন মহান আল্লাহ্‌ পাক দয়া করে বাকীটুকু সম্পন্ন করবেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি। সুতরাং খিলাফাত প্রতিষ্ঠার জন্য কোন গুপ্ত/সন্ত্রাসী আন্দোলন গড়ে তোলা সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন এবং শরীয়ত বিরোধী।।  

লেখকঃ
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
মোহাম্মদ সালেক পারভেজ
সহকারী অধ্যাপক,
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.bd 

প্রথম প্রকাশঃ মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৯ ইং বাংলাটপনিউজ২৪ডটকমে



নিম্নের ছবিটিতে বা লিঙ্কে ক্লিক করে পিডিএফ (pdf) ফাইলটি ডাউনলোড করে বা preview করে পুরো লেখাটি পরতে পারেন। 




1 টি মন্তব্য: