-->

আল-কুরআনের অবিকৃতিঃ একটি মহাবিস্ময়

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জমানাতে সম্পূর্ণ কুরআনের হাফেয ছিল অনেক ; কিন্তু সমগ্র কুরআন একত্রে লিপিবদ্ধ ছিল না ( কারো কারো নিকটে কিছু কিছু অংশ অবশ্য লিখিত আকারে ছিল) হযরত আবুবকর সিদ্দীক রাঃ-এর যুগে ইয়ামামার জিহাদের পরে গোটা কুরআন শরীফকে একখণ্ডে (one volume) একত্রায়িত করা হয় (১৩-১৪ হিঃ, 633-634 খৃঃ) এটিই প্রথম লিখিত সুবিন্যস্ত কোরআন এর বৈশিষ্ট্য হলো –– এটিকে রাসুল (সা.) বর্ণিত ধারাক্রম অনুসারে লেখা হয়েছে এবং এখানে কেবল সেসব আয়াত লেখা হয়েছে, যেগুলোর তিলাওয়াত রহিত হয়নি এই সংকলনের উদ্দেশ্য ছিল একটি সুবিন্যস্তগ্রন্থিত কোরআনের কপি মওজুদ রাখা, যাতে প্রয়োজনের সময় উহার দ্বারস্থ হওয়া যায় এই কপিটি আমৃত্যু হযরত আবু বকর (রাঃ) এর কাছে ছিল এরপর উহা হযরত উমর (রা.)-এর কাছে ছিল তাঁর অসিয়ত মোতাবেক তার শাহাদাতের পর উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা (রা.)-এর কাছে  বর্ণিত কপিটি সংরক্ষিত  ছিল।

      
হযরত ওসমান (রাঃ) এর আমলে দেখা গেল দুরবর্তী এলাকার অনেকেই রাসুল (সাঃ) যেরকম উচ্চারণ (pronunciation -এর কথা বলা হচ্ছে, accent-এর নয়)  শিখিয়েছিলেন সেরকম উচ্চারণ করতে পারছে না তাতে অনেক স্থানেই অর্থের বিকৃতি হয়ে যাচ্ছিল উচ্চারণে একরূপতা (uniformity) আনার জন্য হযরত হাফসা (রাঃ)-এর নিকট সংরক্ষিত সংকলনটি হতে হযরত উসমান রাঃ উক্ত খন্ডের ৭টি অনুলিপি প্রস্তুত করে ( হিঃ ২৫-৩০, ৬৪৬-৬৫১ খৃষ্টাব্দপবিত্র মদিনা নগরীতে এক কপি রেখে অন্য ৬টি কপিকে তৎকালীন ইসলামী জাহানের প্রধান স্থান সমূহ যথাঃ মক্কা, কুফা, বসরা, দামেস্ক, ইয়েমেন এবং বাহরাইনে পাঠিয়ে দিলেন 

প্রত্যেক কপির সাথে তিনি দক্ষ ক্বারিদেরকেও পাঠান যাতে তারা শিক্ষার্থীদেরকে বিশুদ্ধ রূপে কুরআন পাঠ শিখিয়ে দিতে পারেন তাছাড়া যাতে পরবর্তীতে কোন মতপার্থক্য তৈরী না হয় সেজন্য তিনি বিচ্ছিন্নভাবে নানা জনের কাছে সংরক্ষিত অন্য সকল কপি পুড়িয়ে ফেলার আদেশ জারি করেন পরবর্তীকালে এই ৭টি কপি থেকেই কুরআন শরীফের অনুলিপি তৈরি হতে থাকে এবং আজ পর্যন্ত তাই হচ্ছে কিয়ামাত পর্যন্তও তাই হবে তফাৎ কেবল এটুকুন যে, এক সময়ে অনুলিপি প্রস্তুত হত হাতে, পরবর্তীতে মুদ্রন যন্ত্রে

সাহাবীগণ শ্রেষ্ঠতম উম্মত হওয়ার এটিও একটি নিদর্শন যে, বিশ্বনবীর ইন্তেকালের পর তারা বিশ্বনবীর উপর অবতীর্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী  গ্রন্থটিকে বিশুদ্ধভাবে সংকলিত করেছেন যেখানে অন্যান্য নবীগণের মৃত্যুর পরে তাদের উম্মতরা নবীর উপরে অবতীর্ণ কিতাবকে বিকৃত করে ফেলে। সকল প্রশংসাই মহান আল্লাহ্পাকের!       

কুরআন সংরক্ষণে কুদরতি ব্যবস্থা                                                       

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) কর্তৃক সংকলন (৬৩৪ খ্রীঃ, ১২/১৩ হিঃএবং হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক  উহার অনুলিপি প্রস্তুতির মধ্যে  ১২ বৎসরের বেশী ব্যবধান। অথচ উক্ত সময়ে  তৎকালীন মুসলিম জাহানে লক্ষ লক্ষ হাফেজ তৈরি হয়েছে, প্রতিটি মুসলমান কুরআন পড়েছে এবং কমবেশ কিছু অংশ মুখস্থ করেছে তাদের কারোরই প্রয়োজন হয়নি সেই মূল কপিটির দ্বারস্থ হওয়ার কিন্তু ইতিহাসে একটি উদাহরণও খুঁজে পাওয়া যায় নি যে দুজনে দুই রকম কুরআন শিখেছে। এ এক মহা বিস্ময়কর ব্যাপার ! আসলে এটা ছিল কুদরতে-ইলাহীর অনুপম নিদর্শন   

         
নিশ্চয় আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই তার হেফাজাতকারী (১৫:) এই ঘোষণা অনুসারে মহান আল্লাহ্‌ পাক যে-কোন ধরণের বিকৃতির হাত থেকে পবিত্র কুরআনকে নাযেল হওয়ার ক্ষণ থেকে আজতক হেফাত করে আসছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত করবেন। যেহেতু মহান আল্লাহ্‌ পাক ব্যাখ্যা করে বলেন নি ঠিক কোন পদ্ধতিতে তিনি তাঁর কালামকে হেফাযত করবেন, মানুষের পক্ষে ঐ পদ্ধতি নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ হয়নি। বরং  কুরআনের শত্রু এবং মিত্র উভয় ধরণের মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে অবলোকন করল যে কুরআন শরীফ সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে যথাযথ সংরক্ষিত হয়ে আসছে! 

মানুষ কোন কিছুকে সংরক্ষণ করতে হলে নানাবিধ বস্তুর সাহায্য নেয়। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর মহান কালামকে হেফাযাত করার জন্য মূল মাধ্যম রূপে সরাসরি মানুষকে নিয়োজিত রেখেছেন। তাই মানুষ পাক-কুরআনকে হেফাযাত করছে তার সর্বাধিক মূল্যবান ৩টি অঙ্গ যথাঃ মন-মস্তিস্ক-মুখ দ্বারা। মানুষ মন দ্বারা কুরআনকে বিশ্বাস করছে, মস্তিস্ক দ্বারা স্মরণে রাখছে এবং মুখ দ্বারা পঠন পদ্ধতি পর্যন্ত এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দিচ্ছেবিষয়টি নিয়ে খানিকটা বিশদ আলোচনার দরকার মনে করি। যেমন নজরুল/রবীন্দ্রনাথ অনেক কবিতা লিখেছেনকিন্তু প্রতিটি কবিতা তারা আবৃত্তি করেছেন বা তাদের সামনে আবৃত্তি করে কোন একটি দল ইপ্সিত দক্ষতা অর্জন করেছে এমন তথ্য কোথাও নেই। পক্ষান্তরে পাক-কুরআনের প্রতিটি আয়াত বিশ্বনবী স্বকণ্ঠে তিলাওয়াত করেছেন, একবার নয় বরং বহুবার শত শত এবং এক পর্যায়ে হাজার হাজার সাহাবী ঐ আয়াত সমূহ নবীজিকে অবিকল অনুকরণ করে পড়েছেন এবং মুখস্থ করেছেন তাদের কাছ থেকে তাদের স্ত্রী-সন্তানরা আবার মুখস্থ করেছেন এবং সবচে গুরুতপূর্ণ  বিষয় এটা, যে যতটুকুই মুখস্থ করতেন, তার শিক্ষক ততক্ষণ তাকে সত্যায়িত করতেন না যাবৎ শতভাগ শুদ্ধতা অর্জিত হত এভাবেই সাহাবীদের কাছ থেকে তাবেয়িগণ এবং তাবেয়িদের কাছ থেকে পরবর্তীগণ  শব্দ, উচ্চারণ সহকারে কুরআন মুখস্থ করেছেন। এখানে ওস্তাদ এত কঠোর ছিলেন যে যাবত না সাগরেদ ওস্তাদের ১০০% প্রতিবিম্ব হয়েছেন, ততক্ষণ ঐ ছাত্রের জন্য কোথাও কুরানুল-কারিমের শিক্ষাদান নিষিদ্ধ ছিল । এই কড়াকড়ির ফল এটা হত যে কোন ছাত্র যখন সফলতার সাথে হেফজ সমাপ্ত করত তখন গুরু-শিষ্যের পড়ার মধ্যে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত গলার আওয়াজ ছাড়া অন্য কোন পার্থক্য পাওয়া যেত না। শিক্ষাদানের এই পদ্ধতি গোটা মুসলিম জাহানে গত সাড়ে ১৪০০ বৎসর ধরে চলে আসছে। ( বিষয়টি হাতে-কলমে বুঝতে হলে আপনি বিশ্বের যে কোন দেশের যে কোন হেফজখানায় গিয়ে কিছুদিন অতিবাহিত করুন)। 

এটা আজ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে নাজেল হওয়ার পর থেকে বিশ্বনবীর শিখানো পদ্ধতিতে কুরানুল-কারিমের তিলাওয়াত পৃথিবীতে একদিনের জন্যও বন্ধ হয় নি শুধু তাই নয় ! প্রতি রমযান মাসে মক্কা শরীফে এবং মদিনা শরীফে ২০ রাকাত খতম তারাবীর নামায সেই হযরত উমার (রাঃ)র আমল থেকে আজ পর্যন্ত নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে আর এই নামাযে শত-সহস্র হাফেয হাজির থাকে যে, কোথাও একটি দাড়ি-কমা ভুল হলেই তাৎক্ষণিক সংশোধন হয়ে যায় ইহার ফলে  যেটা হয়েছে সেটা হল সেই মূল কুরআনটিই যাহা মহান রাসুল (সাঃ) এর উপর নাজেল হয়েছিল (এবং পরবর্তীতে আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) কর্তৃক সংকলিত হয়েছিল এবং আরো পরে উসমান রাঃ কর্তৃক প্রচারিত হয়েছিল) উহা সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় আমাদের নিকটে পৌঁছেছে। এভাবে মহান আল্লাহ্‌ পাকের আর একটি ঘোষণা  নিশ্চয়ই তাহা(অর্থাৎ কুরআন) অতি সম্মানিত এক কিতাব। যাতে মিথ্যার অনুপ্রবেশ অসম্ভব --- না সামনে থেকে, না পেছন থেকে। (তাহা) প্রজ্ঞাবান, সমস্ত প্রশংসার অধিকারীর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ (৪০: ৪১-৪২) বাস্তবরূপ লাভ করল। 

কুরআনের হস্তলিখিত এবং মুদ্রিত অনুলিপিসমূহ এক্ষেত্রে বিরাট সহায়ক হিসাবে কাজ করেছে। আর কুরআন শরীফ নকল (হস্তলিখিত এবং মুদ্রিত, উভয় ক্ষেত্রে) করার সময় নকলকারী এই পরিমাণে সতর্ক থাকতেন যাতে একটি নুখতা-হরকতের কিম্বা ওয়াকফের পার্থক্যও না হয়!  সুতরাং আজ প্রতিটি মুসলমান সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারছে, তার ঘরে যে কুরআন শরীফটি আছে উহাই সেই মূল কুরআনকারো পক্ষে এ কথা বলার কোন সুযোগই নেই যে কুরআন- শরীফের অমুক অমুক পৃষ্ঠা হারিয়ে গিয়েছিল, এখন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজতে গিয়ে ঐগুলোকে পাওয়া গেছে ; ঐগুলোকে কুরআন-শরীফে সংযুক্ত করা দরকার। বরং তেমন কিছু নিয়ে কেউ হাযির হলে প্রতিটি মুসলমান বিনা দ্বিধায় বলবে, আল্লাহ্‌ পাক কর্তৃক নাজেলকৃত কুরআন- শরীফটিই ঘরে ঘরে, মসজিদে মসজিদে আছে। খুঁজে পাওয়া পাতায় যা লেখা আছে উহা যদি আমার ঘরে রাখা কুরআন-শরীফের সাথে মিলে যায় তবেই গ্রহণ করব আর যদি না মেলে তবে গ্রহণ করার প্রশ্নই ওঠে না।

লেখকঃ
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
মোহাম্মদ সালেক পারভেজ
সহকারী অধ্যাপক,
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.bd 

প্রথম প্রকাশঃ সোমবার, ২৭ মে, ২০১৯ ইং বাংলাটপনিউজ২৪ডটকমে



নিম্নের ছবিটিতে বা লিঙ্কে ক্লিক করে পিডিএফ (pdf) ফাইলটি ডাউনলোড করে বা preview করে পুরো লেখাটি পরতে পারেন। 





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন