-->

হিজরত : সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম প্রেম-উপাখ্যান

(প্রেমের জন্য মানুষ অনেক কুরবানি করে। তবে প্রেম বলতে আমাদের স্থূল দৃষ্টিতে যা ভেসে ওঠে, দৃষ্টিটাকে সম্প্রসারিত করে সেই সর্গে আমরা মা-বাবা-সন্তান, বন্ধু-বান্ধব, গুরু-শিষ্য ইত্যাদি বহুবিধ ভালোবাসাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। সাহাবীদের নবীপ্রেম ছিল তেমনি একটি বিষয়। তবে ওটা ছিল নজিরবিহীন !  আর ঐ বে-নজীর নবীপ্রেমের কারণে এই আসমান-যমীন সাক্ষী হয়ে আছে অনেক অচিন্তনীয় ঘটনার। ঐ সকল ঘটনাগুলোর মধ্যে যেটি শ্রেষ্ঠতম, সেটির কথা শুনাচ্ছি)




৬২২ খ্রিস্টাব্দ

মক্কা নগরী 

দিন যায়, রাত আসে দিনান্তের কর্মশেষে একে একে প্রায় সকলে ঘুমিয়ে পরে কিন্তু সুপ্তিমগ্ন বসুন্ধরার বুকে শত ক্লান্তি সত্ত্বেও সারাটি রাত সদা-সতর্ক জেগে থাকেন একজন শুধু জেগে নয় ! দুয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে, কান খাড়া করে অপেক্ষা করেন !! গত কয়েকমাস ধরে প্রতিটি নিশি তিনি এভাবেই পার করছেন !!!    

কে তিনি ? 

তিনি আর কেউ নন, তিনি হযরত আবুবকর রাযিয়াল্লাহু তালা আনহু

কি তার পরিচয় ?

তার অনেক পরিচয়। স্বাধীন পুরুষদের মধ্যে তিনিই প্রথম মুসলমান। অধিকন্তু তিনি একজন সিদ্দীকতবে সব পরিচয়ের সেরা পরিচয় হল, দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত লোকের ওপরে সূর্য আলো দিয়েছে , দিচ্ছে এবং দেবে তাদের মধ্যে নবী(আলাইহিস সালাম)গণ বাদে আর সকলের চেয়ে তিনি উত্তম !                                        

তাহলে এমন এক মহামানবের আবার কিসের তরে এই পাগলপারা নীরব প্রতীক্ষা?

সেই প্রতীক্ষা কেবল প্রিয়তমের তরফ থেকে একটি ডাকের, একটি আহবানের।

কে সে-ই আহবানকারী ? কে সেই প্রিয়তম !  

তিনি আর কেউ নন, তিনি নবীসম্রাট, তিনি বিশ্বনবী। তিনি মহান স্রষ্টার সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি, কুল মাখলুকের প্রেমাস্পদ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ শ্রেষ্ঠতম নবীর ডাকের প্রতীক্ষায় রাতভর দাঁড়িয়ে থাকেন, যারা নবী নন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মানুষটি। 

কেন

বিশ্বনবীর প্রথম ডাকেই যেন সাড়া দেয়া যায়। প্রাণের চেয়েও প্রিয় নবীজি দ্বিতীয়বার ডাকবেন ! অসম্ভব !! জান থাকতে নবীজিকে এতটুকুন কষ্ট দেয়া যাবে না।    

সে-ই ডাকটিই বা কিসের তরে ? 

সে ডাক ত্যাগের তরে, যথাসর্বস্ব কুরবানীর জন্য। প্রিয় নবী বলেছেন, আবুবকর যেন প্রস্তুত থাকে। যে  কোনদিন মহান আল্লাহ্‌ পাক হুকুম দিতে পারেন হিজরত করার জন্য। মানে আজন্ম বাস করে আসা এই শহর, এই বাড়িঘর, বন্ধু-বান্ধব, বাবা-মা, ভাইবোন, বউ-বাচ্চা, কায়কারবার সব কিছু ছেড়ে চিরতরে চলে যেতে হবে, শুধু রাসুলের সাথী হয়ে।

কোথায় ? 

এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে।   

পাঠক! একটু ভাবুন। প্রেম কাহিনীর অনেক উপাখ্যান জেনেছেন, কিন্তু হজরত আবুবকর(রাঃ)র ন্যায় সর্বস্ব কুরবানীর নিয়তে এভাবে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত কারো কথা শুনেছেন কী! শুনেন নাই, কখনো শুনবেনও না। কারণ, এটা কোন চপলমতি বালক বা তরুণের আবেগপ্রবণ হৃদয়ের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয়। এটা ছিল পঞ্চাশ বৎসরের এক পৌঢ়ের ধীরস্থির, ইস্পাতকঠোর সংকল্পদুনিয়ার বুকে কোন আশিক তার মাশুকের জন্য এভাবে যামিনীভর জাগে নাই, জাগবেও না।

*     *     *     *      *     *     *     *     *     *     *

অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ !

এক আঁধার রজনীতে বিশ্বনবী -এর কাছে ওহী এল মক্কা ছেড়ে মদিনা চলে যাবার জন্য। তিনি প্রস্তুত হলেন।

কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই বিশেষ রাতটিতে শুধু হযরত আবুবকর(রাঃ) একাই নন, জেগে ছিল আরও অনেকে তবে তারা ছিল মনুষ্য সূরতে হিংস্র পশু তাদের হাতে ছিল উন্মুক্ত অসি তারা শপথ নিয়েছিল জগতের সকল কালের সবচাইতে নির্মম কাজটি করার জন্য !

কি সেই জঘন্য কাজটি ?

উহা ছিল মহান স্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মুহাম্মাদ -কে হত্যা করা ! সেই ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে সূর্য ডুবার খানিক পরেই ওরা বিশ্বনবী -এর বাড়িটি বেড় দিল উদ্দেশ্য, রাতের কোন এক প্রহরে সকলে সম্মিলিতভাবে রাসুল -কে হত্যা করবে কিন্তু সর্বশক্তিমান রাব্বুল আলামিন যার হেফাজত করেন, কার এমন ক্ষমতা আছে যে তার ক্ষতি করবে ?                                                                      

ওহী পাওয়া মাত্র রাসুলুল্লাহ আপন চাচাতো ভাই আলী(যিনি পাঁচ বৎসর বয়স থেকে নবী-গৃহে বড় হচ্ছেন)-কে ডেকে বললেন, আলী যেন তার বিছানায় শুয়ে থাকে, তিনি মদিনার উদ্দেশ্যে হিজরত করছেন আলী চুপচাপ শুয়ে পড়ল আহ ! কী চমৎকার আত্মসমর্পণ !! না কোন প্রশ্ন, না কোন কৌতূহল !!!

রাসুল দোর খুললেনপবিত্র হাতে নিলেন এক মুষ্টি বালি পড়লেন সুরা ইয়াসিনের প্রথম ৯টি আয়াততারপরে বালিটুকু নিক্ষেপ করলেন অপেক্ষমাণ শত্রুদের উদ্দেশ্যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্পাক তার কুদরৎ জাহির করলেন কাফেররা কিছুই দেখল না ওদের সামনে দিয়েই বিশ্বনবী সাবলীলভাবে বের হয়ে গেলেনপ্রথমে হাজির হলেন আবুবকরের বাড়ীতে, ডাকলেন মৃদু স্বরে সদা প্রস্তুত আবুবকর তৎক্ষণাৎ বের হয়ে এলেনস্বার্থক হল হযরত আবুবকর(রাঃ)-র নিশি জাগরণ !

*     *     *     *      *     *     *     *     *     *     *

শুরু হল সফর 

সময়টি ছিল সফর মাসের ২৭ তারিখের মধ্যরাত 

চাঁদের কৃষ্ণপক্ষ চলছে তখন চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার

হাঁটছেন বিশ্বনবী , সাথে আবুবকর(রাঃ) কিন্তু তিনি  একবার নবীজির পেছনে যান, আবার সামনে আসেন, কিছুক্ষণ ডানে থাকেন তো আবার কিছুক্ষণ বামে ----- এমন করছেনবিস্মিত প্রিয় রাসুল কারণ জানতে চাইলেন। আবুবকর(রাঃ)র বিনীত উত্তর, যখন মনে হয় শত্রু সামনের দিক থেকে আসছে, তখন সামনে যাই। আবার যখন মনে হয় পেছনে, তখন  পেছনে থাকি। পরক্ষণেই মনে হয় ওরা বুঝি ডানদিক থেকে আসছে, তখন ডানে যাই। যখন খেয়াল হয়, বামদিকটা অরক্ষিত, চলে যাই সেদিকেউদ্দেশ্য কেবল একটাই, ওদের আঘাতটা যেন আমার গা-য়ে লাগে, আল্লাহ্‌র নবী যেন হেফাজতে থাকেন।                                   

ধন্য ! হে হযরত আবুবকর(রাঃ) !! ধন্য আপনি !!! এই কুরবানিকে যতভাবেই বর্ণনা করি না কেন, ঐ ভাষা কখনোই যথোপযুক্ত হবে না।

এভাবেই যেতে যেতে পার হল প্রায় ৫-৬ কিমি। একসময়ে তারা পৌঁছলেন ছাওর পাহাড়ের পাদদেশেধীরে ধীরে পাহাড় বেয়ে ওঠতে শুরু করলেন। উদ্দেশ্য, চূড়ার দিকে কোন গর্তে আশ্রয় নেবেন।

পাঠক ! সামনে যাবার আগে স্মরণে রাখুন এই পাহাড় বাংলার ঘাস মোড়ানো সবুজ পাহাড় নয়, ওটা ছিল কঠিন পাথরের পাহাড়ি পথ।  

    

ছাওর পাহাড়
ছাওর পাহাড়ের সেই গর্ত


আল্লাহ্‌র কী লীলা ! রাসুলুল্লাহ ক্লান্তি বোধ করতে লাগলেন, পদযুগল অবসন্ন হয়ে এলো। কিন্তু প্রেমিকশ্রেষ্ঠ আবুবকর বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। সীমাহীন আদবের সাথে কাঁধে কিম্বা কোলে তুলে নিলেন প্রিয় নবীজিকেউফ্‌ ! ধন্য সেই পাহাড়ি পথ ! সে প্রাণভরে দেখল আর সাক্ষী হয়ে রইল এই অনুপম হিম্মতের, অতুলনীয় ভালবাসার। জগতের বুকে কোন আশেক তাঁর মাশুককে এত ভালবাসেনি, সেদিনের আগেও না, সেদিনের পরেও না।

এভাবেই চরাই-উতরাই পেরিয়ে তারা পৌঁছলেন পাহাড়ের চূড়ায়। একটি গুহা খুঁজে নিলেন লুকিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু আবুবকরকে প্রেমের পরীক্ষা যে আবারো দিতে হয় ! সে পরীক্ষা দিতে কিন্তু আবুবকরকে কেউ বলে নি, বলেছিল কেবল তার অন্তর, যে অন্তর ইশকে-রাসুলে ভরপুর।

আবুবকর(রাঃ)র বিনীত নিবেদন, ইয়া রাসুলুল্লাহ , আমি আগে গর্তে ঢুকি। যদি কোন ক্ষতিকর প্রাণী থাকে তবে যেন আঘাতটা আমার ওপরেই আসে। 

তারপর !

পাহাড়ি গুহায় লাফ দিয়ে নেমে গেলেন তিনি। আধো-আলো আধো-আঁধারে দেখলেন ছোট্ট ছোট্ট অনেকগুলো ছিদ্রঢাকবেন কি দিয়ে ? কিন্তু ইশকভরা অন্তর কক্ষনো দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। সে তো খুঁজতে থাকে কুরবানীর পথ ; হোক সেটা মহাসড়ক কিম্বা অলি-গলি-সুরংগ !

হযরত আবুবকর(রাঃ) টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললেন গায়ের জুব্বাটা। এক একটি টুকরো দিয়ে বন্ধ করলেন এক একটি ছিদ্র। তবে একটি খোলা রয়েই গেল। কারণ, কাপড় শেষ। আসলে এও ছিল কুদরতের অদৃশ্য ইঙ্গিত। কারণ কুদরৎওয়ালা মহান রাব্বুল আলামিন যে আজ গোটা বিশ্বকে হাতে-কলমে দেখিয়ে দেবেন সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুলের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমিক হলেন আবুবকর(রাঃ)। এ-ই মোকামের দাবী যেন কেউ কোনদিন না করে। 

সেই ছিদ্রমুখে হযরত আবুবকর(রাঃ) নিজ পায়ের গোড়ালি এমনভাবে স্থাপন করলেন যেন ভিতরের কিছু বাইরে আসতে না পারে। অতঃপর আবুবকরের ইঙ্গিত পেয়ে ছাওর পাহাড়ের সেই গুহায় ঢুকলেন বিশ্বজাহানের রহমত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ আহ ! কি সৌভাগ্যবান সেই গর্তখানা !! তোমার সৌভাগ্যে হতবাক জগতের সকল দালান-কোঠা, ঈর্ষান্বিত পৃথিবীর তাবৎ সোনা-রুপা-হীরার খনি

*     *     *     *      *     *     *     *     *     *     *

ক্লান্ত পথিকের এবার বিশ্রামের পালা। দুজানু পেতে দিলেন হযরত আবুবকর(রাঃ) সেখানে পবিত্র মাথাটি রেখে ঘুমিয়ে গেলেন প্রিয় রাসুল কোন মানুষ দেখল না ! কিন্তু ছাওরের সেই গুহা আর আঁধার রজনী সাক্ষী হয়ে রইল পৃথিবীর সকল কালের সুন্দরতম দৃশ্যটির !! যেন রেহালে রাখা হল আল-কুরআন, তবে এখানে রেহাল জিন্দা-জাগ্রত, আর আল-কুরআন ? অধিকতর জীবন্ত যদিও নিদ্রারত !

কিন্তু আশিকের যে আরও পরীক্ষা বাকী ছিল তখনো ! যে গর্তটি হযরত আবুবকর(রাঃ) পা দিয়ে বন্ধ করেছিলেন, উহার ভিতরে বাস করত কোন এক বিষাক্ত প্রাণী ওটি এখন আর বেরোতে  পারছে না প্রাণীটি ক্ষিপ্ত হয়ে দংশন করতে শুরু করল আবুবকরের গোড়ালিতে

পাঠক! আপনিও জানেন, আমিও জানি, বিষাক্ত প্রাণী কামড় দিতে হয় না, কোন বিষধর প্রাণী দেখলেই মানুষ স্থান-কাল ভুলে গিয়ে লাফিয়ে ওঠে কিন্তু আবুবকর! লাফ তো দুরের কথা, একচুল পরিমাণও নড়লেন না একের পর এক দংশনে হযরত আবুবকর(রাঃ)র শরীর বিষ-ব্যথায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি ? তিনি নীরব-নিশ্চল, স্পন্দনহীন ! দাঁতে দাঁত চেপে সবটুকু ব্যথা সহ্য করে যাচ্ছেন সাচ্চা আশিক তো মাশুকের তরে হাজারবার জান দিতেও প্রস্তুত থাকে, কিন্তু  মাশুকের গায়ে ফুলের আঘাতও সে বরদাস্ত করতে পারে না আর আবুবকরের চেয়ে বড় আশিকে-রাসুল কেউ নয়, হতে পারে না এটা জানা ছিল রাব্বুল আলামিনের, এটা বুঝতেন রাসুলে-আকরাম কেবল জানা ছিল না বিশ্ববাসীর কিন্তু দুনিয়াবাসিকে জানাতে হবে আবুবকরের ইশকের কথা, রাসুলে -এর কাছে আবুবকরের কবুলিয়াতের কথা তাই তো এত আয়োজন !

আবুবকর(রাঃ)  যদিও প্রাণহীন পাথরের মত স্থির, কিন্তু বিষের যন্ত্রণায় আঁখি ভরে গেল অশ্রুতে সেই নয়নবারীর দুফোটা আবুবকরের অজ্ঞাতে গড়িয়ে পড়ল বিশ্বনবীর কপোলে ঘুম ভেঙে গেল রাসুল -এর।  সব শুনে তিনি স্বীয় পবিত্র মুখের পবিত্র থুথু লাগিয়ে দিলেন আবুবকরের দংশিত স্থানে নিমেষেই বিষের ক্রিয়া গায়েব

*     *     *     *      *     *     *     *     *     *     *

এবার পুরষ্কার বিতরণীর পালা যে মাশুক আশিকের কুরবানি কেবল চেয়ে চেয়ে দেখে আর উপভোগ করে, সে তো মাশুক নয়, প্রাণহীন মূর্তি কিন্তু আবুবকরের মাশুক ছিলেন রহমতে দো-আলম, সরোয়ারে কায়েনাত বিশ্বনবী তিনিতো পুরস্কার দেবেন তার মত করেই কিন্তু ওদিকে যে গায়েব থেকে সব কিছু দেখছেন আর নিয়ন্ত্রণ করছেন স্বয়ং রাব্বুল আলামীন। তিনি ঠিক করলেন তার হাবীবের আশিক-কে তিনিও পুরস্কৃত করবেন। আর তাই আবুবকরের ভাগ্যে এমন এক মহান পুরষ্কার জুটল, যা ছিল সকল কল্পনার উর্দ্ধে কী সেই পুরষ্কার ! আসুন না, সামনে এগোই

*     *     *     *      *     *     *     *     *     *     *

ঘটনাবহুল যামিনী বিদায় নিল। ঊষার আলো ফুটল মরুর বুকে। ঘর হতে কাউকে বের হতে না দেখে সারারাত ধরে অপেক্ষমাণ শত্রুরা রাসুল - এর ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লকিন্তু বিছানায় আলীকে ঘুমাতে দেখে তারা অবাক হয়ে গেল। আলীর সাথে কিছুটা বাদানুবাদের পর তারা মুহাম্মাদ -কে খুঁজতে বের হল।                                          

পায়ের ছাপ দেখে খুঁজতে খুঁজতে শত্রুরা এক সময় পৌঁছে গেল গারে-ছাওরের পাদদেশে। তারপর তারা পাহাড়ে আরোহণ করল। চূড়ায় পৌঁছে চারিদিকে খোঁজাখোঁজি শুরু করল। এক সময় তারা পৌঁছে গেল সেই গুহাটির কাছে। এত কাছে যে, গুহার ভেতর থেকে ওদের গলার আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল ! কিন্তু নবীজি নিশ্চিন্ত–নির্ভীক। কারণ ইহা যে নবুওয়াতের শান ! জগতের সকল নবী(আঃ)গণই চরম বিপদের মুখে তাওয়াক্কুলের চূড়ায় পৌঁছে প্রশান্ত হয়ে যান। হযরত ইব্রাহীম(আঃ)-কে যখন আগুনে ফেলা হচ্ছিল, তখন তিনি সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন ছিলেন। ফেরাউন সসৈন্যে তাড়া করতে করতে মুসা(আঃ)-কে যখন এমন অবস্থানে নিয়ে গেল যে সামনে অথৈ লোহিত সাগর, তখন মুসা(আঃ)-ও পরম নিশ্চিন্ত ছিলেন। আর সাইয়্যিদুল মুরসালীনের বেলায় তো শঙ্কিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।                                                        

কিন্তু আবুবকর ! তিনিতো মানুষ । যদিও অসাধারণ, কিন্তু নবীতো নন। তাই তাঁর চিত্ত আসন্ন বিপদের আশংকায় আলোড়িত হচ্ছিল। এক পর্যায় বলেই ফেললেন, “ ইয়া রাসুলুল্লাহ ! ওরা যদি নিচের দিকে তাকায়, তাহলেই আমাদেরকে দেখে ফেলবে।” বিশ্বনবী অভয় দিয়ে বললেন, “ আবুবকর! ঐ দু’জন সম্পর্কে তোমার কি ধারণা, যাদের তৃতীয় জন হলেন আল্লাহ্‌ তা’লা।” পুরষ্কার ঘোষিত হল। কিন্তু নবী-অন্ত প্রাণ আবুবকরের ওদিকে খেয়াল নেই। হয়তো সেই সংকটময় মুহূর্তে তিনি উপলব্ধিও করতে পারন নি কী মহানিয়ামত তার নসীবে এল ! তিনি আবার বললেন, “যদি আমি মারা যাই, তবে একজন আবুবকরই মারা যাবে। কিন্তু আপনি মারা গেলে গোটা উম্মত ধ্বংস হয়ে যাবে।” এবারে আল্লাহ্‌র রাসুল দ্ব্যর্থহীন ভাষায়  বলেই দিলেন, “ দুশ্চিন্তা কর না ; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ আমাদের সাথে আছেন।” আহ্‌! কী সৌভাগ্য আবুবকরের নবী সম্রাট তাঁর জন্য আল্লাহ্‌ পাকের তরফ থেকে আসা সকল নিয়ামতের ভাগীদার করে নিলেন আবুবকরকে। আবুবকরের উত্তরণ হল সিদ্দিক থেকে সিদ্দীক সম্রাটের আসনে !

*     *     *     *      *     *     *     *     *     *     *

মহান আল্লাহ্‌ পাক মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বানিয়েছেন সাধনার মাধ্যমে মানুষ যাতে উঁচু থেকে উচ্চতর সোপানে আরোহণ করতে পারে সে ব্যবস্থা বিশ্বস্রষ্টাই করে দিয়েছেন, হোক সে সাধনা দুনিয়াকে নিয়ে কিংবা আখেরাতকে ঘিরে। দুনিয়াবি ব্যাপারে মানুষ সাধনা করতে করতে যেমন ভূবনবিখ্যাত বিজ্ঞানী-দার্শনিক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হতে পারে, আখেরাতের ব্যাপারে সাধনা করলেও তেমনি তার উন্নতি হতে থাকে। এক পর্যায়ে সে হয়ে যায় ওলী-আবদাল-গাউস- কুতুব কিম্বা আরও বড় কিছু। তবে সর্বোচ্চ যে স্তরে মানুষ পৌঁছতে পারে, তার নাম সিদ্দীকিয়াত। যেমন পরীক্ষায় পাশের বেলায় প্রথম শ্রেণীর ওপরে আর কোন শ্রেণী নেই, (আছে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, দ্বিতীয় ... ইত্যাদি হওয়া) ঠিক তেমনি সিদ্দিকিয়াতের স্তর হচ্ছে আল্লাহ্‌ পাকের সন্তুষ্টির-নৈকট্যের সর্বশেষ শ্রেণী, যা সাধনালব্ধ। (এর ওপরে আছে ‘মাকামে-নবুওয়াত’ যা সাধনালব্ধ নয়, একান্তই আল্লাহ্‌র দান।)হযরত আবুবকর রাঃ তো সিদ্দীক হয়েছিলেন অনেক আগেইকিন্তু হিজরতের রাতে তিনি হয়ে গেলেন সিদ্দীক--আকবার (অর্থঃ শ্রেষ্ঠতম সিদ্দীক)রাসুলুল্লাহ  কর্তৃক প্রদত্ত এই পুরষ্কার রাব্বুল আলামীনের নিকট মঞ্জুর হল।  তাঁর কালামে পাকে হবহু কথাটি তিনি চিরন্তন করে রেখেছেন, “... তিনি ছিলেন দু’জনের একজন যখন তাহারা গুহার মধ্যে ছিল; তখন তিনি(অর্থাৎ রাসুল) তাহার সঙ্গীকে(অর্থাৎ আবুবকরকে) বললেন, “ পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ আমাদের সাথে আছেন।” (৯ : ৪০)” চক্ষুষ্মানগণ ঠিকই বুঝতে পারেন যে এটা নিছক সান্ত্বনা বাণী নয়, বরং এটা ছিল এক অপ্রত্যাশিত নিয়ামত প্রদান (সঠিক শব্দ ব্যবহার করলে বলতে হয় ‘এত্তেহাদী তাওয়াজ্জুহ’ প্রদান) যার কারণে হজরত আবুবকর(রাঃ)র ঈমানী হালত আর দশজনের চেয়ে ভিন্নমাত্রার ছিল। হযরত আবুবকর(রাঃ)র পরবর্তী জিন্দেগীর প্রতিটি কাজে এই বিশেষ হালতের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। কঠিন থেকে কঠিনতর বিপদের মুখেও হযরত আবুবকর(রাঃ)কে বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে কোনদিন কেউ দেখেনি।।

*     *     *     *      *     *     *     *     *     *     *

এই অপরিপক্ক লেখকের সাধ ছিল বটে, কিন্তু তার কলমে এত জোর নেই যে হজরত আবুবকর(রাঃ)র  ঐ রাতের কুরবানীকে কাগজের পাতায় শব্দের মালায় গাঁথতে পারে তবে লেখকের সান্তনা যে এক্ষেত্রে সে কেবল একাই ব্যর্থ নয় এখানে এসে না-কামিয়াব হয় দুনিয়ার তাবৎ লেখকের সকল কলমগুলো কারণ ওটাতো শুধু হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার জন্য কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র হৃদয়ে ঐ উপলব্ধিটুকুও পুরোমাত্রায় আসে না ওটা অনুভব করতে হলে প্রয়োজন অর্ধ জাহানের খলীফা হযরত উমার(রাঃ)র অন্তরের মত বিশাল আত্মা, যিনি কাঁদতেন আর বলতেন, “ আমার গোটা জিন্দেগীর সব আমলের বিনিময়েও যদি আবুবকরের হিজরতের সেই রাতটুকু পেতাম !”                     

কিছু তথ্যঃ

ছাওর পাহাড়টি মসজিদে হারাম থেকে প্রায় ৫-৬ কিমি. দক্ষিণে অবস্থিত। ৩টি সংযুক্ত পাহাড়ের সমষ্টিকে ছাওর পাহাড় বলা হয় এবং দুই পাহাড় অতিক্রম করার পর তৃতীয় পাহাড়ে ওই গুহাটি অবস্থিত। পাহাড়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৫৪টি উঁচু-নিচু মোড় আছে। নিচ থেকে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত গুহাটি একটি ছোট নৌকার মতো দেখায়কারণ উহার পিঠ উপরের দিকে। গুহাটি মাটি থেকে ৪৫৮ মিটার এবং সমুদ্রের স্তর থেকে  ৮৫৮ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। গুহাটির দৈর্ঘ্য ১৪ ফুট এবং সংকীর্ণ মুখের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৪ ফুটের মত। গুহাটিতে দুটি প্রবেশ পথ রয়েছে। পশ্চিম পাশের পথ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রবেশ করেছিলেন। পূর্ব পাশের পথটি অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত। গুহায় যাবার জন্য বর্তমানে সিঁড়ি করা আছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেও দেড়-দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এই গুহায় রাসূলুল্লাহ (সা.) আবু বকরকে (রা.) সঙ্গে নিয়ে তিন দিন আত্মগোপন করেছিলেন। অতঃপর পুনরায় মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ৮ রবিউল আওয়াল (মদীনার উপকণ্ঠে)  কুবা পল্লীতে পৌঁছেন সেখানে ৪ দিন অবস্থান করেন। অতঃপর ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।।


লেখকঃ
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
মোহাম্মদ সালেক পারভেজ
সহকারী অধ্যাপক,
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি, ঢাকা ১২০৭

ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.bd 



নিম্নের ছবিটিতে বা লিঙ্কে ক্লিক করে পিডিএফ (pdf) ফাইলটি ডাউনলোড করে বা preview করে পুরো লেখাটি পরতে পারেন। 





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন