(এই
লেখাটি কতটুকু মান সম্পন্ন তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু বর্ণিত বিষয়টির গুরুত্ব
তর্কাতীত। অথচ তিক্ত অভিজ্ঞতা হল, অনেক স্থানেই লেখাটি পাঠিয়েছিলাম, কেউ ছাপে নি,
এমনকি নারী অধিকারের ধ্বজাধারীরাও না। বুঝতে বাকি রইল না যে, সবখানেই ' ডাল মে
কুঁচ কালা হ্যাঁয় ।' যাহোক বাংলাটপনিউজ২৪ডটকম ছেপেছে, এ
জন্য তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ। প্রিয় পাঠক ! এই লেখাটির গুরুত্ব আপনি উপলব্ধি
করবেন, যদি লেখাটি পড়ার আগে কিম্বা পরে আপনার আম্মাকে জিজ্ঞাসা করেন, "
আম্মা! নানা - নানী থেকে ওয়ারিশান সূত্রে প্রাপ্য আপনার হিস্যাটুকু পুরোপুরি পেয়েছেন
কি ? " উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকে, তবে আপনার আম্মা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী। আর যদি ‘না’ উত্তর পেয়ে থাকেন,
তবে ‘মা’-এর প্রাপ্য আদায়ের
জন্য আপনি কী করবেন সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আপনি যাতে হিম্মৎ করেন, আমি ঐ চেষ্টাটুকুই
করছি। )
মহান আল্লাহ্ পাক সৃষ্টি করেছেন নারী এবং পুরুষ, উভয়কে। তবে তিনি তার
অসীম জ্ঞান মোতাবেক উভয়ের গড়নে ও স্বভাবে পার্থক্য রেখেছেন। এটা নিয়ে কেহ কোনদিন
দ্বিরুক্তি করে নি। সেই মহান আল্লাহ্-ই তাঁর অসীম এবং সর্বপ্রকারের দোষত্রুটি
মুক্ত জ্ঞান অনুসারে নারী ও পুরুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব, কর্তব্য এবং অধিকার নির্ধারণ করেছেন এবং মানবজাতির প্রতি একান্ত করুণা
করে ঐগুলোকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়েও দিয়েছেন। মানবজাতির কর্তব্য এই বিধানগুলোকে
বাস্তবায়িত করা। এতে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয়।
যে সকল বিষয়ে আল্লাহ্ পাক সুস্পষ্ট বিধান দিয়েছেন, উহাদের মধ্যে মহা
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল উত্তরাধিকারের সম্পত্তি বণ্টন। এতে রয়েছে
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে নারীদের অধিকারের একটি দ্ব্যর্থহীন ও
পরিপূর্ণ বর্ণনা।
(ইসলামী নামধারী গুটিকয়েক মুরতাদ শ্রেণীর নারী ব্যতীত এই
ব্যাপারে কারো কোন আপত্তিও নেই।)অতএব, এতে পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল
বর্ণিত অধিকারসমূহ যাতে সঠিকভাবে আদায় হয় সেই ব্যবস্থা করা। অথচ ইহা একান্ত পরিতাপের
বিষয় যে, বিশ্বের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে নারীদেরকে ছলে-বলে নানা কৌশলে তাদের
প্রাপ্য উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
আইনের অপপ্রয়োগ
এদেশে ‘হেবা’ নামক একটি আইন
আছে। আইনটি করা হয়েছিল অনেক মহৎ উদ্দেশ্যে। অথচ এদেশের নারীদেরকে যে কয়টি সুরতে
উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত করা হয় ওগুলোর মধ্যে প্রধানতম প্রক্রিয়াটি হল ‘হেবা আইনের অপব্যবহার’। এই অপব্যবহারটি সাধারণতঃ এভাবে ঘটে। মালিক
মারা যাওয়ার পরে নানা অযুহাতে সম্পত্তি বণ্টন করা হয় না। যেহেতু সম্পত্তিটুকু
প্রথম থেকেই ভাইদের কব্জায় থাকে, বেচারি বোন ধরেই নেয় যে, ওটা সে পাবে না। অনেক স্থানে বোনেরা থাকে অসহায়া-দুর্বল, ভাইদের দাপটের কারণে তারা তাদের প্রাপ্য হকের ব্যাপারে কথা বলতেও সাহস
পায় না। অনেক ক্ষেত্রে পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয়া হয়, উত্তরাধিকার
বুঝে নিলে বাপের বাড়ীতে যেন আর কোনদিন না আসে, ভাইবোনের
সম্পর্ক ওখানেই ইতি। বহু পরিবারে বোনদেরকে প্রাপ্য সম্পত্তির বড়জোর দশ ভাগের এক
ভাগ দাম দিয়ে বাকিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়। আবার অনেক পরিবার থাকে
কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ওখানে বোনদেরকে এই বলে ব্রেন-ওয়াশ করা হয় যে, মেয়েরা বাপের বাড়ীর সম্পত্তি নিলে উহাতো টিকবে না, এমন কি তাদের স্বামীর সম্পত্তিও ধ্বংস হয়ে যাবে! অতঃপর এক সময় সুযোগমত
ভাইরা বোনদেরকে কোর্টে নিয়ে যায় এবং “আমি স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে
পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত আমার সমুদয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আমার ভাইকে হেবা করে
দিলাম” --- এই বলে বোন
কর্তৃক লিখিয়ে নেয়। একটি মহৎ আইনের এমন অপব্যবহারের উদাহরণ আর নেই। যুগ যুগ ধরে
এদেশে এই হচ্ছে। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে দেখেছি যত মহিলা ভাইদেরকে সম্পত্তি হেবা
করেছে, তারা নিতান্ত বাধ্য হয়েই করেছে। আইন এবং সমাজ
তাদের পক্ষে ছিল না।
পরামর্শ
বর্ণিত অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমি কিছু সুপারিশ প্রস্তাব
করছি।
(১) নামজারি এবং কব্জা ব্যতীত কেহ কাউকে কোন কিছু হেবা
করতে পারবে না। প্রচলিত ‘হেবা’ আইনে একটি বড় ফাঁক
আছে। ‘হেবা’ শুদ্ধ হওয়ার জন্য হেবাকারির
ভোগদখল শর্ত, তবে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বেলায় জরুরী নয়।
বোনদেরকে সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করার সকল চাবিকাঠি কিন্তু এখানেই নিহিত। অথচ,
আইনে কেবল ছোট্ট একটি বিধান যথাঃ উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত
সম্পত্তিও কেহ হেবা করতে পারবে না “(ক) যদি না উহা তার
নামে জারী থাকে এবং (খ) সে বাস্তবে উহার কব্জাকারী না হয় ” থাকলেই সম্পত্তিতে
নারীদের উত্তরাধিকার নিশ্চিত হয়ে যায়।
(২) কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পরে বিনা ফী-তে সর্বোচ্চ ৩
মাসের ভেতরে ওয়ারিশান সনদ প্রস্তুত করতে হবে এবং সর্বোচ্চ ৬ মাসের মধ্যে
ভাগ-বাটোয়ারা শেষ করে প্রত্যেক ওয়ারিশের নামে নামজারি করে নিতে হবে। জনগণ যাতে
বিষয়টি গুরুত্ব দেয়,
সেজন্য বিলম্বতা জনিত শাস্তি থাকা দরকার।
(৩) ২০০০ সালের পরে নামজারি ব্যতীত যত হেবা করা হয়েছে, সবগুলোকে বাতিল ঘোষণা
করা হোক। অতঃপর যদি কেহ হেবা বজায় রাখতে চায়, তবে তাকে
প্রথমে নামজারিপূর্বক সম্পত্তির মালিকানা ভোগদখলে নিতে হবে। ইহার পরেই সে হেবা
করতে পারবে, অন্যথায় নয়। আর হেবাকৃত সম্পত্তি
বিক্রি/হস্তান্তর হয়ে গেলে উহার মূল্য/ক্ষতিপূরণ হেবা প্রাপকের পক্ষ থেকে
হেবাকারিকে (বাধ্যতামূলক) প্রদান করতে হবে (তবে ২০০০ সালের পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ
ঘটনা খুবই নগণ্য সংখ্যক হবে)। আসলে আমি বলতে চাইছিলাম যে, সি এস থেকে যত হেবা হয়েছে সবগুলোকে বাতিল করতে। কিন্তু ওতে যে হুলস্থূল
বাধবে, অনেকটা বাধ্য হয়েই Doctrine of
Necessity –র খাতিরে ঐদিকে গেলাম না। তবে এটা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা
যেতে পারে যে,
নামজারির পূর্বে হেবা করেছেন এমন হেবাকারি যদি বেঁচে থাকেন,
তবে তিনি দরখাস্ত করলেই ঐ হেবা (যত বৎসর আগেরই হোক না কেন)
তৎক্ষণাৎ বাতিল হয়ে যাবে এবং যার পক্ষে হেবা করা হয়েছে সে কোন ধরণের আইনি ব্যবস্থা
তথা আপিল ইত্যাদি করতে পারবে না।
(৪) শুধু হেবা বাতিলই যথেষ্ট নয়, হেবা বাতিলের পরে মূল
মালিক যাতে সরেজমিনে দখল নিতে পারে তার জন্য দরকার এমন সকল ধরণের আইনি সহায়তা
নিশ্চিত করতে হবে।
(৫)
উল্লেখিত সকল কাজগুলোর জন্য ফি ইত্যাদি যথাসম্ভব কম নির্ধারণ করা। কারণ এতে মানুষ
আইনি প্রক্রিয়া গুলো এড়াতে চাইবে না।
পত্রিকার পাতায় স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা অসম্ভব
বিধায় আমি কেবল ভাইবোন সংক্রান্ত বিষয়টি আলোচনা করেছি। নচেৎ একজন নারী নানাভাবে
যথাঃ মা এবং স্ত্রী হিসাবেও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় এবং যথারীতি বেশীরভাগ
ক্ষেত্রে বঞ্চিতা থাকে। অতএব, এ জাতিয় সকল ক্ষেত্রে অনুরূপ বিধান
থাকা জরুরী যে কব্জা এবং নামজারি ব্যতীত যেন সে ঐ সম্পত্তি হেবা করতে না পারে।
প্রধানমন্ত্রী সমীপে
আমি বলছি না যে, ‘হেবার’ বিধান পুরোপুরি
বাতিল করতে। কিন্তু ব্যবস্থাটা এমন করা হোক যাতে ‘হেবার অপব্যবহারের’ কারণে নারীরা (এবং
অন্য কেহ) যেন তার প্রাপ্য অধিকার হতে বঞ্চিত না হয়। আমি আমার ক্ষুদ্র
জ্ঞানে কিছু প্রস্তাব রেখেছি । তবে আইন বিশেষজ্ঞরাই বুঝবেন কীভাবে কি করতে হবে।
একজন নাগরিক হিসাবে প্রত্যাশা করতে পারি যে বর্তমান সরকার বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব
দেবে যদিও এ পর্যন্ত কেহ এদিকে নজর দেয় নি। কারণ এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, প্রতিটি জনবান্ধব সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল একজন নারীর (এবং অন্য
সকল নাগরিকের) প্রাপ্য অধিকারসমূহ আদায় ও ভোগের নিশ্চয়তা প্রদান করা। এমন কি আমি
এটাও আশা করি যে বিষয়টি কোন না কোন ভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর
হবে এবং এ ব্যাপারে তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেবেন।
লেখকঃ
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
মোহাম্মদ সালেক পারভেজ
সহকারী অধ্যাপক,
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.bd
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
মোহাম্মদ সালেক পারভেজ
সহকারী অধ্যাপক,
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.bd
প্রথম প্রকাশঃ বাংলাটপনিউজ২৪ডটকমে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন