( মিরাজ কে যারা অস্বীকার করে তাদের জন্য এ লেখা নয়। মিরাজকে দৃঢ়ভাবে
বিশ্বাস করে, কিন্তু বিজ্ঞান মনস্ক হওয়ার কারণে যুক্তি খুঁজে বেড়ায়, এমন মানুষ অনেক আছে। এই অনুসন্ধানটুকু
অনেক সময়ে আত্মপ্রশান্তির জন্য, অনেক সময়ে প্রতিপক্ষকে জবাব দেবার জন্য। কারণ
যেটা-ই হোক না কেন, তাদের কৌতূহল নিবারণের
তরে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। )
সাইয়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ(সাঃ)এর পবিত্র
জিন্দেগী জুড়ে রয়েছে অজস্র অলৌকিক ঘটনা যেগুলোকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘মুযিযা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এই সকল ঘটনা সমুহ নির্ভরযোগ্য এবং বিশুদ্ধতম ‘সনদের (অর্থাৎ বর্ণনা
সুত্রের )’ মাধ্যমে আমাদের নিকটে পৌঁছেছে ।
প্রিয় নবীর (সাঃ) মুযিযা
সমূহের মধ্যে একটি বিশিষ্ট মুযিযা হল মিরাজ। রাসুল
(সা.)-এর ৫২তম বছর বয়সে নবুওয়াতের
১২তম সনে হিজরতের ১ বা ২ বছর আগে রজব মাসের ২৬ তারিখ রোজ সোমবার দিবাগত রাতে মিরাজুন্নবীর(সা.) আশ্চর্যতম ঘটনাটি সংঘটিত হয়।
মুসলমান মাত্রই মিরাজের বিবরন শুনে অভিভূক্ত হয়, আল্লাহ পাকের সীমাহীন কুদরতের সামনে নিজের অক্ষমতা
উপলদ্ধি করত সিজদাবনত হয়, বিগলিত চিত্তে উচ্চারণ করে, ' সুবহানাল্লাহ ' । কিন্তু যারা বিশ্বাস আর যুক্তির টানা হেঁচড়ার ফাঁদে পড়ে গেছে, তাদের হয়েছে
সমস্যা। বিগত কয়েক বছর যাবৎ একটি
বিষয় বেশ ভালভাবেই চোখে পড়ছে যে,
একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী মিরাজকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাখ্যা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। দিনের পর দিন এই ধরনের ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। আরবী রজব মাস এলেই বিভিন্ন সাময়িকীতে ইহাদের লেখা পাওয়া যেতে থাকে। আর এই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এরা হয় মিরাজকে নয় বিজ্ঞানকে স্বীয় মর্জিমত অপব্যাখ্যা করছে। আলোচ্য প্রবন্ধে এই বিষয়েই যৎকিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হবে।
একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী মিরাজকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাখ্যা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। দিনের পর দিন এই ধরনের ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। আরবী রজব মাস এলেই বিভিন্ন সাময়িকীতে ইহাদের লেখা পাওয়া যেতে থাকে। আর এই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এরা হয় মিরাজকে নয় বিজ্ঞানকে স্বীয় মর্জিমত অপব্যাখ্যা করছে। আলোচ্য প্রবন্ধে এই বিষয়েই যৎকিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হবে।
তবে প্রথমেই আমরা
জেনে নেব বিশ্বস্ত হাদীস থেকে মিরাজের ধারাবাহিক বর্ণনাঃ
(১) হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)
হাতীমের মধ্যে শায়িত ছিলেন। হযরত জীব্রাঈল(আঃ)
সহ মোট তিনজন ফেরেশতা হুজুরের
(সাঃ) নিকটে আসলেন। তারা হুযুরের (সাঃ)এর বক্ষ বির্দীণ করেন । অতঃপর ক্বলব বের করে
উহাকে জমজমের পানি দ্বারা ধুয়ে ঈমান ও হিকমত দ্বারা পরিপূর্ণ করে পূর্বস্থানে
পুণঃস্থাপন করেন।
(২) অতঃপর প্রিয় নবীর(সাঃ) নিকট বোরাক
নামক সাদা রঙের একটি জন্তু আনা হল। জন্তুটি গাধা হতে একটু বড়, খচ্চর হতে কিছুটা
ছোট ছিল। উহার গতি বিদ্যূতের ন্যায় এরূপ ছিল
যে এক একটি পা জন্তুটি উহার দৃষ্টির শেষ প্রান্তে ফেলত পারত । বোরাকের উপরে গদি বসানো ও মুখে লাগাম ছিল। হুযুর(সাঃ) উহার পিঠে আরোহণ করতে গেলে (আনন্দের আতিশয্যে ) উহা নড়াচড়া
শুরু করল। তখন জীব্রাঈল(আঃ) উহাকে ধমক দিলেন । বোরাক ধীরস্থির হয়ে দাড়িয়ে গেল । উহার সমস্ত শরীর হতে (পূর্ব
ব্যবহারের কারণে লজ্জায় ) ঘাম ঝরতে লাগল। অতঃপর হুযুর(সাঃ) বোরাকে আরোহন করলেন। জীব্রাঈল(আঃ) বোরাকের
রিকাব (অর্থাৎ গদিতে বসে দু’পাশে পা রাখার লোহার
বেড়ী) ধরলেন ও মিকাঈল(আঃ) বোরাকের লাগাম ধরলেন। হুযুর(সাঃ) রওয়ানা হলেন।
(৩) হুযুর (সাঃ)
গন্তব্যপথে তিন জায়গায় বোরাক হতে নেমে নফল নামায পড়লেন। জায়গাগুলো হচ্ছে- প্রথমত: মদীনা, দ্বিতীয়ত: মাদায়েন, তৃতীয়ত: বাইতুল
লাহাম।
(৪) বাইতুল মোকাদ্দাসে
পৌছে হুযুর(সাঃ) বোরাককে একটি গোলাকৃতি পাথরের সাথে বাঁধেন। অতঃপর মসজিদে প্রবেশ করেন।
সেখানে যে সকল ঘটনা ঘটে তার মধ্যে রয়েছেঃ
(ক). আম্বিয়াগন(আঃ) ও ফেরেশতা (আঃ) গণের ইমাম হয়ে নামায
পড়া।
(খ). দোযখের তত্ত্বাবধায়ক মালেক ফেরেশতা ও অন্যান্য আম্বিয়া(আঃ)গণের
সাথে পরিচিতি লাভ।
(গ). হুযুর(সাঃ)
এর নিকট কয়েকটি পেয়ালা পেশ করা হয়, যেগুলোর মধ্য থেকে
প্রিয়নবী (সাঃ) দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করেন ও পান করেন।
(৫) অতঃপর হুযুর(সাঃ)
‘বোরাক’ অথবা ‘জিনাহ (অর্থাৎ সিঁড়ি)’ দ্বারা আসমানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
(৬) হুযুর (সাঃ)
যখন প্রথম আসমানে পৌছলেন, তখন সাথী জীব্রাঈল(আঃ)এর সাথে আসমানের ফেরেশতাদের কিছু প্রশ্নোত্তর হয়। অতঃপর আসমানের দরজা খোলা হল এবং হুযুর(সাঃ) ভিতরে প্রবেশ
করেন। সেখানে তিনি হযরত আদম(আঃ)এর সাথে সালাম
বিনিময় করেন এবং আরো অনেক বিষয়াদি দর্শন করেন।
এইরূপ হুযুর(সাঃ) ও জীব্রাঈল(আঃ) একে একে সাতটি আসমান পার
হয়ে যান। প্রতি আসমানে উপস্থিত হওয়া মাত্র ঐ আসমানের
ফেরেশতার সাথে হযরত জীব্রাঈল(আঃ) এর কিছু কথাবার্তা হয়। অতঃপর আকাশের দরজা খোলা হলে হুযুর(সাঃ) ও জীব্রাঈল (আঃ) ভিতরে প্রবেশ করেন। বিভিন্ন আসমানে বিভিন্ন নবী(আঃ) এর সাথে হুযুর(সাঃ) এর দেখা-সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা হয় । যথাঃ
২য় আসমানে হযরত ইয়াহিয়া ও ঈসা (আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ হয়;
৩য় আসমানে হযরত
ইউসুফ(আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ হয়;
৪থ আসমানে হযরত ইদরীস(আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ হয়;
৫ম আসমানে হযরত হারুন(আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ হয়;
৬ষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা(আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ হয়;
৭ম আসমানে হযতর ইব্রাহীম(আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ হয়।
সপ্তম আসমানে হুযুর (সাঃ) বাইতুল মা’মূর দর্শন করেন। অতঃপর তাঁকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা
(যাহা ৭ম আসমানে অবস্থিত একটি বৃক্ষের নাম)’ পর্যন্ত উন্নীত করা হয়। ক্রমান্বয়ে তিনি
বেহেশত,দোযখ চাক্ষুস করেন এবং সর্বশেষে আরশে-আযীম
পর্যন্ত উন্নীত হন। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। অতঃপর তিনি দুনিয়াতে ফিরে আসেন। (মিরাজের এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থাবলী
থেকে সংকলিত)।
বিজ্ঞানের মূলকথা
বিজ্ঞানের থিওরী (Theory) আলোচনার পূর্বে
প্রথমেই এই কথাটি ভাল করে বুঝে নেয়া দরকার যে, বিজ্ঞানের প্রতিটি
শাখা-প্রশাখার ‘ সুনিদিষ্ট সীমাবদ্ধতা ও প্রয়োগক্ষেত্র ( defined
limitations and fields of application)’ রয়েছে। যেমন, আপনি বললেন যে,
আমি গণিতশাস্ত্র মানি। তার মানে আপনাকে অবশ্যই মানতে হবে ২+৩ = ৫, ৭× ৮ = ৫৬, ৩৯ ÷১৩ = ৩ ইত্যাদি। কারণ এগুলো গণিতশাস্ত্রের সুনিদিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী প্রমাণিত। যদি কেউ বলে যে আমি গণিতশাস্ত্র মানি না, বুঝি না, বুঝতে পারি না, বুঝতে চাই না বা
গণিত নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই, তবে সেটা ভিন্ন কথা। অথচ ” গণিতশাস্ত্র মানি
কিন্তু ৯+৫ = ১৪ মানি না ” এরুপ বললে বক্তাকে পাগল আখ্যায়িত করে পাবনার পাগলা গারোদে পাঠানোর চিন্তা
করবে বাকি সবাই। অনুরুপ পদার্থ-রসায়ন-গণিত-পরিসংখ্যান ইত্যাদি
সকল শাস্ত্রের সকল ‘থিওরীর
(Theory)’ ক্ষেত্রে বিবিধ ‘স্বীকার্য (Axioms)’ ও ‘সিদ্ধান্ত (Deductions)’ আছে ।
মিরাজ ও আপেক্ষিক তত্ত্ব
(অঙ্কে অনভিজ্ঞরা এই অংশটুকু বাদ দিয়ে পড়লেও ক্ষতি নেই।
পরবর্তী অংশ বোধগম্য হবে।)
মিরাজের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকারগণ মিরাজের ব্যাখ্যা
দিতে গিয়ে খুব জোরেশোরে আইনস্টাইনের ‘ আপেক্ষিক তত্ত্বের ’ উল্লেখ করেন। আমরা নিরপেক্ষভাবে দেখব যে, বিষয়টি
ইসলামের ঈমান আকীদার সঙ্গে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ।
আপেক্ষিক তত্ত্ব মতে গতিশীল বস্তুর দৈর্ঘ্য, ভর
ইত্যাদিতে পরিবর্তন সাধিত হয়। এ সংক্রান্ত সূত্রগুলো নিম্নরূপঃ
I = গতিশীল অবস্থায় বস্তুর দৈর্ঘ্য Io = ঐ বস্তুর স্থির অবস্থার দৈর্ঘ্য |
|
m = বস্তুর চলমান
অবস্থার ভর mo = বস্তুর নিশ্চল অবস্থার ভর |
|
to= স্থির বস্তুর ক্ষেত্রে অতিক্রান্ত সময় t = গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে অতিক্রান্ত সময় |
এক্ষণে বক্তব্য হচ্ছে কেহ আপেক্ষিক তত্ত্ব মানবে কি মানবে
না সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কারণ এটা এত গুরুত্বপূর্ণ
নয় যে, না মানলে কারো জীবন-ধারন অচল হয়ে যাবে। কিন্তু যদি কেউ আপেক্ষিক তত্ত্বকে বিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব
বলে মানে তবে তাকে অবশ্যই উপরের সূত্রগুলোকে মানতে হবে।
এবার মিরাজের ক্ষেত্রে আপেক্ষিক তত্ত্বকে বিবেচনা করা যাক।
‘বোরাক’ শব্দটি আরবি ভাষার ‘বারকুন( ﺐﺮﻖ
)’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘বারকুন’ এর অর্থ বিদ্যুৎ ।
ইহাতে অনেকের ধারণা ‘বোরাক’ বিদ্যুৎ বা
আলোর গতিতে চলেছিল। যুক্তির খাতিরে আমরাও সেটা ধরে নিলাম। যেহেতু বিশ্বনবী(সাঃ) বোরাকের পিঠে উপবিষ্ট ছিলেন, ধরতে হবে যে তিনিও তখন আলোর গতিতে ছিলেন। সুতরাং আপেক্ষিক তত্ত্বের সূত্রগুলোতে v = c বসাতে পারি ।
তাহলে আমরা পাচ্ছি
(1) l = 0
(2) m = ∞
(3) t = ∞
প্রিয় পাঠক! এর অর্থ ধরতে পেরেছেন কি ? সোজা সরল বাংলায়
এর মানে হলঃ
ঐ সময়ে
(4) হুযুরের(সাঃ)
দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ইত্যাদি শূন্য হয়ে গিয়েছিল ;
অর্থাৎ শারীরিক আকার আকৃতির পরিবর্তন হয়ে তিনি বিন্দুবৎ হয়ে গিয়েছিলেন।
(5) হুযুর (সাঃ) অসীম ভরবিশিষ্ট অর্থাৎ ভারী হয়ে গিয়েছিলেন
।
এখন আপনিই বলুন, প্রিয় নবী(সাঃ)-এর শানে এমন গাঁজাখুরী কল্পনা ও বেআদবীমাকা কথাবার্তা শোভা পায় কি ?
তাহলে ব্যাপারটি এই দাঁড়াচ্ছে যে, আপেক্ষিক তত্ত্বকে
মানলে বা বিশ্বাস করলেও মিরাজের ক্ষেত্রে কিন্তু উহাকে প্রয়োগ করা যাবে না।
আপেক্ষিক তত্ত্বের একটি অনুস্বীকার্য “ কোন বস্তুর গতিবেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশী হতে পারে না।” এই পরিপ্রেক্ষিতে এবার কেউ হয়তো বলতেই পারেন যে হুযুর (সাঃ)
এর গতিবেগ আলোর বেগের চেয়ে কম ধরলে তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তাদের জানা উচিত যে বর্তমান বিজ্ঞান এমন অনেক নক্ষত্রের সন্ধান
পেয়েছে যেখান থেকে পৃথিবীতে আলো আসতেই ১০০০ কোটি বৎসরের বেশি সময় লাগে; আর এই সকল নক্ষত্রই পার্থিব জগতে তথা প্রথম আসমানের নিচে
অবস্থিত। মিরাজের বর্ণনায় আমরা জেনেছি যে, হুযুর (সাঃ) গোটা পার্থিব জগতের সীমানা পার হযে গিয়েছিলেন। সুতরাং উনি যদি আলোর গতির চেয়ে কম গতিতে আসা-যাওয়া করে থাকেন, তাতে উনার ২০০০ কোটি বৎসরের বেশি সময় ভ্রমণ করার কথা। অথচ নবী (সাঃ) ভ্রমণ করেছেন “এক রাতের চেয়েও কিছু কম অংশ।” এখানে এসে
কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, হুযুর (সাঃ) হয়তো ঐ পরিমাণ সময়ই ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু মহাবিশ্বে সময় স্থির হয়ে গিয়েছিল । এটা কিন্তু আপেক্ষিক তত্ত্বের সুস্পষ্ট অপপ্রয়োগ। কারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী সময় স্থির হবে ঐ পদার্থের জন্য যেই পদার্থটি আলোর গতিতে চলবে । (দ্রঃ উপরের (3)। উল্লেখিত t = ∞ এর ভাষাগত অর্থ হল ‘সময় স্থির হওয়া’।) উল্লেখ্য যে, মিরাজ হয়েছিল হুযুরের(সাঃ) । গতিতে ছিলেন হুযুর(সাঃ) ও তাঁর বাহন বোরাক। গোটা পৃথিবীর তো মিরাজ হয়নি। তাহলে পৃথিবীর ক্ষেত্রে ‘সময় স্থিরের’ যুক্তি পেশ করা হয় কোন ভিত্তিতে ?
কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, হুযুর (সাঃ) হয়তো ঐ পরিমাণ সময়ই ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু মহাবিশ্বে সময় স্থির হয়ে গিয়েছিল । এটা কিন্তু আপেক্ষিক তত্ত্বের সুস্পষ্ট অপপ্রয়োগ। কারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী সময় স্থির হবে ঐ পদার্থের জন্য যেই পদার্থটি আলোর গতিতে চলবে । (দ্রঃ উপরের (3)। উল্লেখিত t = ∞ এর ভাষাগত অর্থ হল ‘সময় স্থির হওয়া’।) উল্লেখ্য যে, মিরাজ হয়েছিল হুযুরের(সাঃ) । গতিতে ছিলেন হুযুর(সাঃ) ও তাঁর বাহন বোরাক। গোটা পৃথিবীর তো মিরাজ হয়নি। তাহলে পৃথিবীর ক্ষেত্রে ‘সময় স্থিরের’ যুক্তি পেশ করা হয় কোন ভিত্তিতে ?
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে (মিরাজের অন্যান্য অংশ বাদ দিয়েও
) কেবল হুযুরের(সাঃ) ‘উর্ধ্বগমন তথা গতির
অংশটুকুই’ যদি কেউ আপেক্ষিক তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করতে চায়, তাহলে তাকে বিরাট গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে হয়। সুতরাং সকল ধরনের গোঁজামিলের টানাপোড়ন থেকে মুক্ত থাকার সহজতম রাস্তা হচ্ছে আপেক্ষিক তত্ত্ব
( বা অন্য কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ) দ্বারা মিরাজকে ব্যাখ্যার চেষ্টা না করা।
আরো কিছু অপব্যাখ্যা
কেউ কেউ বলতে চান যে ”হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আলোর সমান বেগে ভ্রমণ করে এসেছেন কিন্তু তখন আল্লাহর কুদরতে
হুযুরের শারীরিক ও ভরজনিত কোন পরিবর্তন হয় নাই।” তাদের এই বক্তব্যকে
আমি অগ্রাহ্য করছি না। এমনটি হতে পারে। আল্লাহর কুদরতের কাছে এটা অসম্ভব নয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটিকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলা যায় না।
কারণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলতে বুঝায় বস্তুর
গঠন-প্রকৃতি ইত্যাদির উপর গবেষণা করতে করতে বিজ্ঞানীরা যে সকল
সাধারণ নিয়মনীতি ( general rules ) আবিস্কার
করেছেন, ঐ গুলোর ভিত্তিতে প্রদত্ত ব্যাখ্যা। (এখানে বিজ্ঞান কর্তৃক ধর্মকে অস্বীকার করা হচ্ছে না। কেবল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্বন্ধে বলা হচ্ছে।) এই কারণে মোটর গাড়ি কেন চলে, পানি কেন তাপপ্রয়োগে
বাষ্প হয়, সাবান কেন ময়লা পরিস্কার করে, ক্যামেরায় কেন ছবি ওঠে ইত্যাদি হরেক বিষয় সম্পর্কে মুসলিম-হিন্দু-খৃস্টান
-ইহুদী -আস্তিক-নাস্তিক একই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
দেবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই বলছি যে, যখনি কেহ মিরাজের ঘটনা ব্যাখ্যা
করতে গিয়ে বলে, ”আল্লাহ্ র কুদরতে, ...... এমনটি ঘটেছিল।” ; তখনি সে ব্যাখ্যাটি হয়ে দাঁড়ায় ঈমানভিত্তিক, বিজ্ঞানভিত্তিক নয়।
ঈমান ভিত্তিক ব্যাখ্যা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু সেই ব্যাখ্যাটি গ্রহণযোগ্য হবার
জন্য শর্ত হল ”নির্ভরযোগ্য সনদ।”
বোরাকের গতির ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের নিকট নির্ভরযোগ্য সনদ
পৌছেছে [দ্রঃ(২)]। কিন্তু বোরাক যে সর্বক্ষণ তার পূর্নগতিতে ছুটেছে, ” এই ব্যাপারেও নির্ভরযোগ্য
সনদ রয়েছে ” এরুপ দাবি কি কেউ করতে পারবে ? বরং হাদীসের বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে প্রিয় নবী(সাঃ) কখন
কখন থেমেছেন। আর যদি হুযুর(সাঃ) সিড়ি দিয়েই প্রথম আসমানে
গিয়ে থাকেন, তাহলে তার কি ব্যাখ্যা হবে ? এখন কেহ যদি বলে যে হুযুর(সাঃ) সম্পূর্ণ স্বাভাবিক গতিতেই মিরাজে হাঁটা-চলা
করেছেন, এতে কোটি কোটি বৎসর পার হয়ে যায়; আল্লাহ পাকের কুদরতে গোটা মাখলুক ঘুমন্ত অবস্থায় কোটি কোটি
বৎসর পার করে দিয়েছে, তাহলে এই ব্যাখ্যাটিকে
কি কেউ উড়িয়ে দিতে পারবে ? বরং হাদীসের বর্ণনায়
বুঝা যায় যে, এই কথাটিই অধিকতর যুক্তিসংগত। তথাপি এটিও আমরা গ্রহণ করব না। কারণ এই ব্যাখ্যাটি আমাদের যুক্তি বা কল্পনাপ্রসূত; হাদীস-কুরআনের হুবহু বর্ণনা নয়। আর রাসুলুল্লাহ(সাঃ) সংক্রান্ত কোন বিষয়ে যুক্তি বা কল্পনা
পেশ করার অধিকার মানুষের নেই।
সম্প্রতি একশ্রেণীর তথকথিত ইসলামী চিন্তাবিদ এই মতবাদ পেশ
করেছেন যে বোরাক ‘ট্যাকিওন (Tachyon)’ কণা দ্বারা তৈরি
ছিল। উহাদের এই উদ্ভট মতবাদের কারণ হল, উহারা শুনেছে বা
পড়েছে যে পদার্থবিদ্যায় ট্যকিওন নামক এক ধরনের
কণার আলোচনা আছে, যার গতিবেগ আলোর গতিবেগের চেয়ে বেশি। অতএব, তাদের চট-জলদী সিদ্ধান্ত, বোরাক ট্যাকিওন দ্বারা তৈরি। আফ্ সোস, এদের জ্ঞানের দৈন্যতার প্রতি! সম্ভবত চমক লাগানোর মত নতুন কিছু বলে নাম করার জন্য এরা পাগল
হয়ে গেছে। নচেৎ এমন একটা উদ্ভট কথা ( দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, যার কোন সনদ নেই) তারা বলত না। এই সকল পন্ডিতরা
(!) ট্যাকিওন সংক্রান্ত কিছু পড়েছে বা শুনেছে, কিন্তু বুঝে নাই।
কারণ প্রকৃত ব্যাপার হলঃ
প্রথমতঃ ট্যাকিওন
কণার অস্তিত্ব এখনও আবিস্কার করা সম্ভব হয় নি। আর বিজ্ঞানে অপ্রমাণিত কোন বিষয়কে ভিত্তি করে যদি কোন বক্তব্য
পেশ করা হয, তবে উহাকে আর যাই বলা হোক, ‘বৈজ্ঞানিক মতবাদ’ বলা হবে না।
দ্বিতীয়তঃ বিজ্ঞানীদের বক্তব্য অনুযায়ী ‘ট্যাকিওন’ কণা যদি কোথাও থেকে থাকে, তাহলে উহার গতিবেগ সর্বদা আলোর বেগের চেয়ে বেশি থাকবে। আলোর বেগের সমান বা কম হলেই ট্যাকিওন কনার অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটবে।
অথচ হাদীসের বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট ভাবে বুঝা যায়
যে, বোরাক মাঝে মধ্যে বেশ ধীরে সুস্থে চলেছে
; এমন কি, থেমেছেও । কিন্তু বোরাকতো
অস্তিত্বহীন হয়নি। তাহলে, “বোরাক ট্যকিওনের তৈরি” এই বক্তব্য
কিভাবে গ্রহনযোগ্য হবে ?
আসল কথা হল, বোরাক কিসের তৈরি, এটা জানা আমাদের
ঈমান ও আমল কোনটির জন্যই জরুরী নয়। এই জন্যই পবিত্র হাদীস শরীফে এই অবান্তর বিষয়ের অবতারণা করা হয় নি। অধিকন্তু, বর্ণনায় বুঝা যায় যে, বোরাক বেহেশতী বাহন (প্রাণী)। সুতরাং, যাদের খুব বেশি কৌতুহল, তারা যদি বেহেশতে যায় তাহলে স্বচক্ষে দেখে, এমন কি হাত দিয়ে স্পর্শ করে জেনে নিতে পারবে বোরাক
কিসের তৈরি।
কেহ কেহ আবার মিরাজের ব্যাখ্যার জন্য ”জ্যোতির্ময় দেহ ( Astral Body)” নামক এক অদ্ভুত তত্ত্বের অবতারণা করেন। অথচ, এই তত্ত্বটি ( ইসলামী আকীদাহ অনুযায়ী
) কিছু কুফরি কথার সমষ্টি ছাড়া আর কিছু
না। । তাছাড়া, বর্তমানে এটা এক বাতিল তত্ত্ব। অধিকন্তু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম যে দেহে দুনিয়াতে থাকতেন-খেতেন-ঘুমাতেন, সেই মাটির দেহ নিয়েই মিরাজে গিয়েছিলেন। আর এই জন্যই মিরাজ একটি মুযিযা। এ কথা সত্যিই আমার বুঝে আসে না যে আল্লাহ পাকের অসংখ্য কুদরতের কথা আমরা বিনাদ্বিধায়
বিশ্বাস করি। অথচ মিরাজের বেলায় এক শ্রেণীর লোক নানা
ধরনের মনগড়া ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে উঠেপড়ে লাগে। আসলে এই বেআদবীর মূল কারণ হচ্ছে ”নবী ও নবুয়তের শান” সম্পর্কে অজ্ঞতা।
এতক্ষণ পর্যন্ত হুযুর(সাঃ) কিরুপে উর্ধ্বগমন করেচিলেন, কেবল সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা দেখিয়েছি যে হুযুর(সাঃ) এর ঊর্ধ্বগমনকে ব্যাখ্যা করার
জন্য , যতই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দাঁড় করানো হোক
না কেন, ঐগুলো আসলে গোঁজামিলের সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ বিজ্ঞানের থিওরী দ্বারা মিরাজকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব
নয়।
বিজ্ঞানের অসহায়ত্ব
যারা মিরাজের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, তাদেরকে আরও কয়েকটি বিষয় স্মরন করিয়ে দিতে চাই। মিরাজের বর্ণনায় আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে হুজুর (সাঃ) এর
উর্ধ্বগমন ব্যতীত আরও অনেক বিষয় সেখানে শামিল ছিল।
যেমনঃ
(i) হযরত জীব্রাঈল(আঃ)
দীর্ঘ সময় নবীজীর সাথী ছিলেন।
(ii) হুজুর(সাঃ)
জান্নাত-জাহান্নাম স্বচক্ষে দেখেছেন ইত্যাদি আরও
অনেক ঘটনা। এই সকল ঘটনার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে
কি? পরিস্কার কথায় নেই। বিজ্ঞান এখনও ফেরেশতার অস্তিত্ব স্বীকার করে না, জান্নাত-জাহান্নাম বিজ্ঞান মানে না। মৃত্যুর পর জীবিত
হওয়া বিজ্ঞান স্বীকার করে না। হযরত আদম(আঃ), মূসা(আঃ) প্রমুখ দুনিয়াতে মৃত্যুবরন করেছেন এবং দাফনও হয়েছেন; অথচ আকাশে উনাদিগকে পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানের এমন কোন সূত্র নেই যদ্বারা এইগুলোকে ব্যাখ্যা করা
যায়। বিজ্ঞানের এই না পারা বা অস্বীকারের কারন
হচ্ছে বিজ্ঞানের দুর্বলতা। আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ আর মানুষের মস্তিষ্কের ফসল বিজ্ঞান। সেই বিজ্ঞান তাহলে কতটুকু শক্তিশালী হতে পারে ? আপনি নিজেই চিন্তা করে দেখুন। এহেন দুর্বল বিজ্ঞানকে দিয়ে ‘মহান আল্লাহ্ পাকে সকল কুদরত’ কে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা কিংবা দাবী করা স্রেফ এক চরম নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু না।
প্রসঙ্গতঃ একটি বিষয় আলোচনা করতে হয়। জনৈক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানী বলেন, যেখানে স্থান ও কাল শেষ হয়ে যায় সেই মুহূর্তে বা বিন্দুতে
পৌছলে মৃত সকল মানুষই জেগে উঠবে। যারা বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে দ্বীনের সত্যতা যাচাই করেন, তারা হয়তো এই বক্তব্যে
আনন্দে আটখানা হয়ে যেতে পারেন।কিন্তু ইহাতে খুশী হওয়ার কিছুই নেই।
কারন ব্যাখ্যা করছি।
প্রথমতঃ ইহা একজন বিজ্ঞানীর মন্তব্যমাত্র, বিজ্ঞানমহলে স্বীকৃত
কোন তত্ত্ব ( Theory) এমন কি প্রকল্পও ( Hypothesis) নয়। অতএব, ইহার ভিত্তিতে কোন
সিদ্ধান্ত (Deductions, Preditctions ইত্যাদি) বিজ্ঞানমহলে গ্রহযোগ্য নয়। আর যেই জিনিস বিজ্ঞানমহলে স্বীকৃত নয়, উহাকে বৈজ্ঞানিক মতবাদ বলে না, বলে ব্যক্তিগত মত।
দ্বিতীয়তঃ উদ্ধৃত বক্তব্যকে যদি সত্যি বলে ধরে নেয়া হয়ও , তথাপি মিরাজের ক্ষেত্রে উহা অপ্রযোজ্য। কারন স্থান-কালের শেষ সীমা, কোনটিকে ধরা হবে ?
যদি (জনৈক তথাকথিত চিন্তাবিদের মত) ‘সিদ্ রাতুল মুনতাহা’ - কে শেষ সীমা ধরা হয়ে থাকে, তাহলে মিরাজের বর্ণনাতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে হুজুর (সাঃ) সিদরাতুল মুনতাহার পূর্বেই আম্বিয়া(আঃ)
গণের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেছেন। অতএব, ‘সিদ্ রাতুল মুনতাহা’–কে স্থান-কালের শেষ সীমা ধরা যাবে না। যদি বাইতুল মুকাদ্দাসকে স্থান-কালের
শেষ সীমা (যেহেতু সেখানে সকল আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম হাজির ছিলেন) ধরা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই
প্রশ্ন জাগেঃ
(*) যে সকল আম্বিয়া (আঃ) বাইতুল মুকাদ্দাসের নিকট দাফন না হয়ে
(**) বাইতুল মুকাদ্দাসের নিকট আম্বিয়া (আঃ) ব্যতীত আরও বহু সাধারন লোকের কবর আছে । তারা জীবিত হয়নি কেন?
...... ইত্যাদি ইত্যাদি
।
সোজা কথায়, বাইতুল মুকাদ্দাস যে স্থান-কালের শেষ সীমা নয় এই কথাটা যে কোন আহম্মকও বুঝে।
সোজা কথায়, বাইতুল মুকাদ্দাস যে স্থান-কালের শেষ সীমা নয় এই কথাটা যে কোন আহম্মকও বুঝে।
এইরুপে যে কেহ যতই খোলামনে চিন্তা করবে, ততই উপলব্ধি করবে যে মিরাজকে বিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা
করা যায় না। ইহা কোন স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। বরং ইহা আল্লাহর কুদরতের একটি অনুপম নমুনা । মিরাজের এই যে ব্যাখ্যাবিহীনতা ( inexplicability ), ইহাই মিরাজের বিশিষ্টতা ( especiality ), অনন্যতা ( uniqueness ) ও মহানত্ব ( greatness )। ইহাকে বিনাদ্বিধায় মেনে নেয়াটাই জ্বীন-ইনসানের
কর্তব্য। যে মানতে পেরেছে সেই সৌভাগ্যবান ।
যেরুপ হযরত আবু বকর (রাঃ) বিনা দ্বিধায় মিরাজকে মেনে নিয়েছিলেন। তাই তিনি হয়েছিলেন
‘ সিদ্দিকে আকবর ’। পক্ষান্তরে, যে বা যারা যুক্তিতর্ক ও বিজ্ঞান ইত্যাদির মানদন্ডে মিরাজকে
মাপছে , তারা কেউ কি পেরেছে ‘সিদ্দিকের’ স্তরে পৌছতে ? বরঞ্চ সে পথে চলতে
গিয়ে অনেকেই পথ হারিয়েছে , যেমন হয়েছিল ‘আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের’ প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদের ক্ষেত্রে। আজ থেকে একশ বছর
আগে সে চেয়েছিল মিরাজের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পেশ করতে। তৎকালীন বিজ্ঞানে সেটা সম্ভব হয়নি। তাই শেষমেষ সে মি’রাজকেই অস্বীকার করল এবং নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হল। আজও যারা মিরাজের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে , তাদেরও একই ভয় করা উচিত। কারণ মিরাজ হল মুযিযা। কোন কালেই ইহার মানবীয় ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।
কোন মুযিযারই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়
মুযিযা শব্দটি আরবি ভাষার। এর মূল হচ্ছে عجز ( ইজযুন : অক্ষমতা )। উহা থেকে আরবি ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে اعجاز
( ই’জাযুন : অক্ষম করে দেয়া ) এবং معجزۃ ( মুযিযাহ্ : যাহা প্রতিদ্বন্দ্বীকে অক্ষম করে দেয়, নিরস্ত করে ) এসেছে । আর এই শব্দটিকে যখন সর্বশক্তিমান
মহান আল্লাহ্ পাকের সাথে সম্পৃক্ত করা হবে, তখন বুঝতে হবে যে এটা মহান আল্লাহ্
পাকের কুদরতের এক অনতিক্রম্য বহিঃপ্রকাশ।
এত্থেকে এটাও বুঝা যায়
যে মুযিযা হবে এমন কিছু যাহা বাস্তব কিন্তু মানুষের জ্ঞানে অবোধ্য। কারণ জ্ঞানের দ্বারা যদি ব্যাখ্যাই করা যায়, তাহলে সেই জিনিসের নিকট মানুষ ( কিংবা তার জ্ঞান)
পরাজিত হল কিভাবে ? অর্থাৎ সোজা কথায় “ মুযিযা হচ্ছে আল্লাহ পাকের সৃষ্ট প্রাকৃতিক
আইন বিরোধী বাস্তবতা ; এবং এই বিরোধীতা
স্বয়ং আল্লাহ পাক নিজেই করেছেন । ”
আল্লাহ পাক এই বিশ্ব প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন মানুষ যেন আল্লাহকে
চিনে এবং উপকৃত হয় । এ কারনেই আল্লাহ
পাক মানুষকে কিঞ্চিত ক্ষমতা দিয়েছেন যাতে মানুষ এই প্রকৃতি সম্বন্ধে জানতে পারে। শুধু তাই নয়, মানুষের উপকারের জন্য প্রকৃতিতে তিনি এই বিধানই চালু করেছেন,“ আর তুমি আল্লাহর নিয়ম সমূহে কখনও কোন পরিবর্তন
পাবে না ( ৪৮:২৩) ।”
তাই দেখা যায় দুধ সর্বদা সাদা হয়, সাগরের পানি হয় লবণাক্ত,মধু মিষ্টি হয় আর তেতুল টক
হয় । কিন্তু এটা সহজবোধ্য যে
মহান আল্লাহ পাক স্বয়ং
তাঁর সৃষ্ট কোন নিয়ম-কানুনের অধীন নহেন। তাই যখন ইচ্ছা তখনই
আল্লাহ পাক এই প্রাকৃতিক কানুন ভাংতে পারেন । কারন “নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক সকল বস্তুর (এবং যে সকল কারনে বা নিয়মে
বস্তুসমূহ পরিচালিত হয় ঐ সকল কারন বা নিয়মের) উপর ক্ষমতাশালী” (২:১০৯) ।
অন্যত্র মহান আল্লাহ্ পাক বলছেন , “ বল, আল্লাহ্ যদি
মরিয়ম-তনয় মাসীহ, তাঁহার মাতা এবং দুনিয়ার সকলকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করেন তবে কে আছে
তাঁহাকে বাঁধা দেবার ? আসমান জমীনে এবং উহাদের মধ্যখানে যাহা কিছুই আছে তাহার সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র আল্লাহ্ পাকের। তিনি
যাহা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন ; এবং আল্লাহ্ সর্ব
বিষয়ে সর্বশক্তিমান।( ৫:১৭ )”
তাই দেখা যায় যে
প্রশান্ত মহাসাগর অশান্ত হয়ে যায় ; নিরব ভূতল হঠাৎ কেঁপে ওঠে , সৃষ্ট হয় ভূমিকম্প। এই সকল ক্ষেত্রে
আল্লাহ পাক তারই সৃষ্ট প্রাকৃতিক আইন ভাঙছেন। মহান আল্লাহ পাক কেবলমাত্র যে এতটুকুই ক্ষমতাশালী তা নয় বরং “ যখন কোন জিনিসকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা তাঁহার হয়, তখন শুধু একটি মাত্র আদেশের দরকার হয় যে “ কুন (অর্থঃ হয়ে যাও )”, তৎক্ষণাৎ সেই জিনিস হইয়া যায়। (৩৬:৮৩)।”
আল্লাহ পাকের অসীম ক্ষমতার এই বিশেষ প্রয়োগেই মুযিযা
সংঘটিত হয়। লক্ষ্য করুন:
প্রাকৃতিক বিধান
|
সংঘটিত মুযিযা
|
|
১
|
কোন পাথর ভাঙলে পাথর ভিন্ন কিছু পাওয়া যায় না, কোন প্রাণীরতো প্রশ্নই ওঠে না।
|
পাথর ফেটে গিয়ে হযরত সালেহ(আঃ)এর উষ্ট্রী বের হয়েছিল
(কুরআন)।
|
২
|
মৃত প্রাণী জিন্দা হয় না।
|
ইব্রাহীম(আঃ)এর ডাকে মৃত চারটি পাখি
জীবিত হয় (কুরআন)।
|
৩
|
হাতের ছোঁয়ায় জন্মান্ধ ভাল হয় না।
|
ঈসা(আঃ)এর শুধু হাতের ছোঁয়ায় জন্মান্ধ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায় (কুরআন)।
|
৪
|
শুধু হাতের চাপে লোহা গলানো যায় না। ( অধিকন্তু লোহার গলনাঙ্ক 15000 C যেখানে কোন মানুষের শরীরের তাপমাত্রা মাত্র 370
C ।)
|
দাউদ (আঃ) খালি হাতে চাপ দিলে লোহা গলে যেত অথচ দাউদ (আঃ)এর
হাতের কিছুই হত না । (কুরআন)othc
|
৫
|
সূর্য সর্বদা একই নিয়মে চলিঞ্চু অর্থাৎ ঘূর্ণায়মান।
|
ইউশার(আঃ) খাতিরে সূর্য থেমে গিয়েছিল (বুখারী) ও হুযুরের
(সাঃ) দোয়ায় সূর্য পূর্বদিকে ফিরে যায় (তরজমানুস সুন্নাহ)।
|
৬
|
গোটা দুনিয়ার সকল মানুষও যদি চাঁদের দিকে ইশারা করে, কিছুই ঘটবে না।
|
হুযুর (সাঃ)এর ইশারায় চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয় এবং পুনঃ ইশারায়
জোড়া লাগে (কুরআন-হাদীস)।
|
৭
|
এক গ্লাস দুধ বা পানিকে পান করা হয়ে গেলে গ্লাসটিতে কিছুই
থাকবে না।
|
হুযুরের(সাঃ) পরিবেশনায় এক গ্লাস দুধ একে এক ৭০ জন সাহাবী
পান করার পরও গ্লাসটি ভর্তি ছিল (ফাজায়েলে আ’মল,
খাসায়েসুল কুবরা-২য় খণ্ড ) ।
|
৮
|
মানবদেহ থেকে স্বাভাবিক পানি বের হয় না। হয়তো পেশাব নয়তো ঘাম বেরুবে।
|
হুযুরের (সাঃ) অঙুলী হতে এত পানি বের হয়েছিল যে ১৪০০ সাহাবী
উহাতে প্রয়োজন মিটিয়েছিল
(বুখারী শরীফ)।
|
৯
|
বন্য প্রাণী মানুষের কথা বুঝে না এবং মানুষের মত কথা
বলতে পারে না।
|
হুযুরের (সাঃ) প্রশ্নের জওয়াবে একটি গুইসাপ প্রকাশ্যে
প্রাঞ্জল আরবি ভাষায় তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করে। ( খাসায়েসুল কুবরা,
২য় খণ্ড )।
|
বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত এমন যে কেউ মুক্তকন্ঠে স্বীকার করবে
যে পৃথিবীতে এমন কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নেই যদ্বারা উল্লিখিত ৯টি মুযিযাকে ব্যাখ্যা
করা যায়। এখানে উদাহরণ স্বরূপ মাত্র ৯টি মুযিযার কথা বলা হল। নতুবা কালের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যত মুযিযা সংঘটিত হয়েছে,
উহাদের প্রত্যেকটির বেলাতেই এই কথা সত্য যে
বিজ্ঞান দ্বারা মুযিযাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। হয়ত কেউ বলবে, ভবিষ্যতে মুযিযা ব্যাখ্যাকারী বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ( Theory) তৈরি হতে পারে। কিন্তু আমি আপনাকে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়েই
বলছি তেমন কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কোন কালেই মানুষের করায়ত্ত
হবে না। একথা তিনিই স্বীকার করবেন যিনি মুযিযার
তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বিখ্যাত মনিষী হযরত ইমাম কুরতুবীর (রঃ, ১২১৪-১২৭৩
খৃষ্টাব্দ) মতে যে কোন মুযিযার জন্য পাঁচটি শর্ত প্রয়োজন।
যথাঃ
প্রথমতঃ মুযিযা এমন হতে হবে যা করার সাধ্য আল্লাহ ব্যতীত কারোই নেই।
দ্বিতীয়তঃ মুযিযাকে অভ্যাস
বিরুদ্ধ (অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম) হতে হবে।
তৃতীয়তঃ মুযিযার মুকাবিলায়
কেহ অনুরুপ কর্ম পেশ করতে পারবে না।
চতুর্থতঃ ‘সাহেবে মুযিযা’ (অর্থাৎ মুযিযা
প্রদর্শনকারী ) মুযিযাকে তার অর্জিত বা সাধনালব্ধ বা গবেষণালব্ধ না বলে পরিষ্কার
ভাষায় বলে দেবেন যে, এটা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ।
পঞ্চমতঃ মুযিযা সর্বদা ‘সাহেবে মুযিযার’ পক্ষে থাকবে যাতে
মুযিযাকে তিনি তাঁর পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ
করতে পারেন।
পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক
ঘটনাবলীর বেলায় এই কথা প্রযোজ্য নয়। উদাহণস্বরূপ পাখির আকাশে ওড়ার বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। এটা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, মুযিযা নয়। শত শত বৎসর গবেষণা করে মানুষ পক্ষীকূলের আকাশে ওড়ার কারণ
বের করল। অতঃপর ঐ কারণকে ভিত্তি করে আরও বহু গবেষণার
পর বিমান আবিষ্কার করল। তদ্রুপ কোন মুযিযার
রহস্য যদি উদঘাটন করা যায়, তখন একদল বেআদব দাবি করবে যে মুযিযা ঘটানো সম্ভব। অথচ আমাদের আকীদা হল, মুযিযা শুধু মাত্র আম্বিয়া(আঃ) গণের জন্য খাছ। ঐ কারণেই আম্বিয়া(আঃ) গণের প্রদর্শিত মুযিযার বিরুদ্ধে যারাই নেমেছিল, তারা হয় হালাক হয়েছে, নয় পরাজয় স্বীকার করেছে ।
যত গভীরভাবে চিন্তা করা হবে, ততই এটা স্পষ্ট থেকে
স্পষ্টতর হবে যে মুযিযার রহস্যভেদ করা মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব। কিন্তু ‘ মুযিযাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব’ ক্রম
বিস্তারশীল এই ‘বক্তব্য বা গলদ বিশ্বাসের’ কারণে মানুষ এমন কি মুসলমানগণও ইদানীং মুযিযাকে ‘অজেয় কিছু ( something invincible and unconquerable
)’ রূপে না দেখে দুর্লভ প্রাকৃতিক ঘটনা যথাঃ টর্নেডো, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস ইত্যাদির ন্যায় ভাবতে শুরু করছে। অথচ মুযিযা যে এগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং অনেক উঁচুস্তরের, সেটা চক্ষুষ্মাণের নিকট দিবালোকের চেয়েও স্পষ্ট।
মুযিযা প্রদর্শনের উদ্দেশ্য
মুযিযার অপ্রাকৃতিকতা ( unnaturality) ও অব্যাখ্যাতা (
inexplicability) মেনে নেয়ার পরে অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক
যে মুযিযা প্রদর্শনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি ? ইহার উত্তর পেতে হলে ’নবুয়তের’ উদ্দেশ্য বুঝতে হবে। কারণ মুযিযা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নবুয়তের উদ্দেশ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বরং বলা যায় যে উভয়টির উদ্দেশ্য অন্তর্নিহিতভাবে এক। মহান আল্লাহ পাক কর্তৃক একজন মানুষকে নবুয়ত প্রদানের উদ্দেশ্য হল জ্বীন-ইনসানকে ’গায়রুল্লাহ’র ইবাদত থেকে মুক্ত
করে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদতে
নিয়োজিত করা। ‘ নবুয়ত ’ মানুষের গবেষণালব্ধ বা সাধনায় অর্জিত নয় ; ইহা আল্লাহ পাকের একটি বিশেষ নিয়ামত যাহা
আল্লাহ স্বীয় ইচ্ছামত কোন কোন বান্দাকে দান করেছিলেন এবং ঐ সমস্ত বান্দাগণকে
হুকুম দিয়েছিলেন যেন তাঁরা প্রাপ্ত নবুয়তের কথা সর্বসমক্ষে ঘোষণা দেয়। এখন চিন্তা করে দেখুন কোন ব্যক্তি কর্তৃক ’নবুয়ত’ দাবির ফলাফল কি হতে পারে ? এই জগতে সবাই স্ব স্ব দাবির পক্ষে কিছু না কিছু প্রমাণ পেশ করে থাকে। কবি কবিতা লিখে, প্রাবন্ধিক প্রবন্ধ রচনা করে, গল্পকার গল্প তৈরি করে, ঐতিহাসিক ইতিহাসের তথ্য উদঘাটন করে, বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কার করে, ধনী ধনের বর্ণনা দিয়ে
স্ব স্ব দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। অথচ প্রাকৃতিক নিয়মে জন্ম নিয়ে এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে বড় হয়ে একজন ব্যক্তি নবুয়তের দাবি করছে অর্থাৎ এমন
কিছুর দাবি করছে যাহা চেষ্টায়-সাধনায়-গবেষণায়-পরিশ্রমে অর্জন করা অসম্ভব। অতএব, এই দাবীর স্বপক্ষে এমন দলীল-প্রমাণ থাকা আবশ্যক
যাহা চেষ্টায়-সাধনায়-গবেষনায়-পরিশ্রমে অর্জন অসম্ভব। নবুয়তের সপক্ষে উত্থাপিত এই অজেয়-অকাট্য-অখন্ডনীয় দলীলই মুযিযা নামে পরিচিত। কারণ ইহার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এসে নবুয়ত অস্বীকারকারীদের ও নবুয়তের বিরোধীদের সকল প্রচেষ্টা চক্ষের পলকে
ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। মুযিযার এই একক (unique) বৈশিষ্ট্যই সকলের
চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে ‘ সাহেবে-মুযিযা অর্থাৎ নবী (আঃ)গণ’ তাদের নবুয়তের দাবিতে
সঠিক। অতঃপর যারা মুযিযাকে যাদু ইত্যাদি বলে
উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল তারা নিজেরাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে, প্রকৃত সত্য উপলব্ধিকারিগণ
নবী(আঃ)র আনুগত্যে নাম লিখেন, এমন কি নিজের জানের বিনিময়ে হলেও। যেমন হয়েছিল ফিরাউনের যাদুকরগণের ক্ষেত্রে। মূসা(আঃ)র সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে ঐ যাদুকরেরা মুযিযা দেখল এবং বুঝতে পারল
যে মূসা(আঃ) সত্য নবী। ফলে, তারা তৎক্ষণাৎ ঈমান এনে মুসলমান
হয়ে যায়। অতঃপর ফিরাউন কর্তৃক তাদের হাত-পা কাটা হয়, কিন্তু তারা ঈমানকে বিসর্জন দেয়নি। কট্টর বিরোধীদেরকে তাদের পথ-মত থেকে এমনভাবে আমূল বদলে দেবার জন্য একজন নবী(আঃ)কে মুযিযাবিহীনভাবে কল্পনাই করা যায় না। হাদীস শরীফেও এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় ”এমন কোন নবী ছিলেন না যাহাকে কিছু
না কিছু মুযিযা দেওয়া হয় নাই। (বুখারী)”
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, মুযিযা নবুয়তের পরে দান করা হয় অর্থাৎ মুযিযা হল নবুয়তের ফল, ভিত্তি নয়। ব্যাপারটি এরূপ যে প্রথমে মহান আল্লাহ্ পাকের তরফ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ (যথাঃ ইব্রাহীম(আঃ), নূহ(আঃ), মূসা(আঃ)- ) কে জানানো হয় যে তাদেরকে নবুয়ত প্রদান করা
হয়েছিল। অতঃপর বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদেরকে বিভিন্ন ধরনের মুযিযা দান করা হয়েছিল। কখনো এরূপ হয়নি যে কোন ব্যক্তি অলৌকিক কিছু প্রদর্শন করল, অতঃপর তাকে নবুয়ত দান করা হয়েছে। বরং যারা এই ধরনের অলৌকিক কিছু প্রদর্শন করত ’নবুয়ত প্রাপ্তির’ দাবি করেছিল তাদের সকল জারিজুরি-প্রতারণা মহান আল্লাহ
পাক ফাঁস করে দিয়েছিলেন এবং তাদেরকে সমূলে ধ্বংস
করে দিয়েছিলেন। যদি এই বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকে, তবে অলৌকিক কিছু ভেল্কিবাজী দেখিয়ে নবুয়ত দাবি করে দেখুক
তার কি জঘন্য পরিণতি হয়।
মুযিযা প্রকাশিত হওয়ার সাথে
সাথে উহা জ্বীন-ইনসানের মনে-মন্তিষ্কে এমন প্রচন্ড আলোড়ন তুলত যে উহার
পরে একমাত্র হঠকারিতা বা গোয়ার্তুমি ছাড়া প্রকৃত সত্যকে অস্বীকারের কোন কারণ থাকে না। কারণ মুযিযা মানুষকে
সরাসরি গোটা জাহানের প্রকৃত স্রষ্টা ও তার শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়ে দিত। এই বিশ্ব চরাচরে ছোট-বড় প্রতিটি বস্তুর কিছু কিছু ‘ গুণ বা ধর্ম ( properties or characteristics )’ আছে । যেমন আগুনের ধর্ম
জ্বালিয়ে দেয়া। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ দেখেছে আগুনের
এই সর্বগ্রাসী রূপ। আর এই দেখতে দেখতে তার মন-মেধার উপর পর্দা পড়ে গেছে। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম
(আঃ)এর ঘটনায় মানুষ দেখল
যে দহনক্ষমতা আগুনের অবিচ্ছেদ্য ও নিজস্ব ধর্ম নয়, বরং এমন কোন মহা শক্তিশালী সত্তা কর্তৃক আগুনকে এই বৈশিষ্ট্য দেয়া হয়েছে যিনি যে কোন
মুহুর্তে আগুনের এই ক্ষমতা রদ করতে পারেন। অর্থাৎ আগুন ও তার দাহিকা শক্তি কোনটিই স্থায়ী ও স্বয়ম্ভু নয়। এই উভয়টিরই এমন একজন স্রষ্টা আছেন যিনি আগুনের উপর সার্বক্ষণিক ক্ষমতার অধিকারী। তদ্রুপ আদিকাল থেকে মানুষ জেনেছে যে পানির ধর্ম প্রবাহিত হওয়া, লোহা-পাথর-কাঠ ইত্যাদি কঠিন পদার্থের ন্যায় পানিকে ভাগ করা
যায় না। কিন্তু হযরত মূসা(আঃ)র সাগর পাড়ির সময়ে মানুষ দেখল পানির ঐ ধর্মও
সৃষ্ট ; স্থায়ীও নয়, স্বয়ম্ভুও নয়। এইরূপে প্রতিটি মুযিযাই ছিল পথহারা মানব চেতনার প্রতি একটি প্রচন্ড ধাক্কা।
প্রতিটি মুযিযাই এ কথা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরেছে যে এই জগতে কোন কিছুই না স্বয়ম্ভু, না স্থায়ী। অধিকন্তু সকল কিছুই তাদের অস্তিত্বের জন্য
সর্বক্ষণ এক মহান অদৃশ্য সত্তার করুণার মুখাপেক্ষী। সেই মহান সত্তার নাম ‘ আল্লাহ্ ’ ; তিনি সর্বশক্তিমান এবং যাবতীয় শরীক থেকে
মুক্ত । ইহাকে তাওহীদ বলে। আর এই তাওহীদ সম্বন্ধে জ্ঞানদানই ছিল আম্বিয়া (আঃ)এর প্রথম দায়িত্ব। আর এই কারণেই জাগতিক সব ধরণের
ডর-ভয়-লাঞ্চনা-গঞ্জনা-জুলুম-নির্যাতন-অপমান-অপবাদ উপেক্ষা করে নির্ভয়-নিঃশঙ্ক
চিত্তে কেবলমাত্র মহামহিম এক আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরশীল থেকে বিশ্ব মানবতার প্রতি আমরণ
তাঁদের উদাত্ত আহবান ছিল,
“ বল ( অর্থাৎ পরিপূর্ণ বিশ্বাস সহকারে ঘোষণা দাও যে ) আল্লাহ্
এক ;
আল্লাহ্ কারো
মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁহার মুখাপেক্ষী ;
তিনি কাহাকেও জন্ম
দেন নাই এবং তাঁহাকেও জন্ম দেয়া হয় নাই ;
এবং তাঁহার সমকক্ষ কেহ নাই, ( ছিল না এবং হবেও না ) (১১২: ১-৪)।”
: সমাপ্ত :
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
(১) মাসিক
মদিনা, ডিসেম্বর ১৯৯৬ সংখ্যা। একই শিরোনামে উক্ত সংখ্যায় আমি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ
করি। কিন্তু উক্ত প্রবন্ধে মুদ্রণ জনিত প্রচুর ভূল ছিল (এমনকি আমার নামটিতেও, যথাঃ
‘সালেকের’ স্থলে ‘সালেহ’ লেখা হয় ), যেগুলোকে পরবর্তীকালে সংশোধন করার কোন সুযোগ হয়নি। বর্তমান
প্রবন্ধটি ঐ প্রবন্ধের Carbon Copy নয়। বরং ইহা একটি পরিবর্ধিত, পরিবর্তিত এবং পরিমার্জিত সংস্করণ।
(২) আবুবকর
সিদ্দীক মিজী, আমার একজন ছাত্র। এত বড় প্রবন্ধটি তার সাহায্য ব্যতীত কম্পোজ করা
আমার পক্ষে সম্ভবপর হত না।
লেখকঃ
মোহাম্মদ সালেক পারভেজ
সহকারী অধ্যাপক,
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.bd
ধন্যবাদ স্যার ।
উত্তরমুছুনThank you Sir
উত্তরমুছুনGood
উত্তরমুছুন