খালেদের মনটা ভীষণ খারাপ। দেশে চলছে টানা
অবরোধ আর হরতাল। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি-অফিস-আদালত- কল-কারখানা সবখানেই এক ধরণের
অচলাবস্থা। সরকার কিম্বা বিরোধীরা কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না।মাঝখান দিয়ে নাভিশ্বাস
ওঠছে আম-জনতার, বারো-তের পার হয়ে চৌদ্দটা বাজতে চলছে দেশের। মার্চ মাস, মানে
স্বাধীনতার মাস এসেছে। কিন্তু কারো মধ্যে তেমন কোন উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে না।
রাস্তাঘাটে সকলের মধ্যে কেমন যেন এক অজানা আতঙ্ক ভাব চোখে পড়ে, ঠিক যেমনটি ছিল
১৯৭১ সালে। ’৭১-এর কথা মনে
পড়তেই খালেদ খুঁজে বের করল তার প্রিয় ডায়েরীটি।
খালেদের
মনে পড়ল আনা ফ্রাংকের ডায়েরীর কথা। ওটা আজ বিশ্ব বিখ্যাত। আসলে ইহুদীরা জানে কার
ঢোল কোথায়, কখন এবং কিভাবে পেটাতে হয়। অপকর্মে তারা বিশ্বসেরা । অথচ ওদের প্রতি
বিন্দুমাত্র অবিচার হলে সেটা এমনভাবে ফলাও করে যে গোটা দুনিয়ায় ওদের প্রতি দরদ
উথলে ওঠে। এজন্যই কি মসী অসির চেয়ে শক্তিশালী ?
বিধ্বস্ত মন আর বিক্ষিপ্ত ভাবনা নিয়ে খালেদ ডায়েরীর পাতা
ওলটাতে থাকে। আচ্ছা, ওর এই ডায়েরী কি কখনো ছাপার অক্ষরে আলোর মুখ দেখবে!
আনমনে হেসে ফেলে খালেদ।আরে দূ---র! মাথাটাই গোলমাল হয়ে গেছে। নচেৎ এসব বিদঘুটে
ভাবনা আসছে কেন ? ও কী তেমন কেউ না কী যে ওর ডায়েরী কেহ ছাপাতে যাবে ? তাছাড়া
বর্তমান প্রজন্মের কাছে একাত্তর কী আদৌ মূল্যবান কিছু ?
ডায়েরীর একটি পাতায় এসে খালেদের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়।
কারণ? কারণ, একটিমাত্র শব্দ, ‘
ঠিকানাবিহীন ’। খালেদ
পড়তে শুরু করে ঐ শিরোনামে কী লিখেছিল। পড়ার সাথে সাথে সেদিনের ঘটনাবলি তার সামনে
যেন ভাসতে থাকে।
* *
* *
*
২৫ শে মার্চ, ১৯৭১ সাল।
রাত প্রায় ৯ টা। রাতের খানা শেষ করে খালেদ শুয়ে আছে। পাশের
রুমে আম্মুর সাথে ঘুমাচ্ছে ছোট বোন আইরিন আর ছোট ভাই খোকন। বাবা এখনো বাসায়
ফেরেনি, তাই খালেদের কিছু ভাল লাগছে না। বাবা একজন সরকারি চাকুরে। তেমন আহামরি
কিছু নয়, আবার এক্কেবারে ফেলনাও নয়, মোটামোটি মাঝারি মানের। বঙ্গবন্ধুর ৭-ই
মার্চের ভাষণের পর অফিসে তেমন কোন কাজকর্ম হয় না, আবার না গেলেও চলে না। বাবা
সাধারণতঃ সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফেরেন। কিন্তু আজ অনেক দেরী করছে। দুশ্চিন্তার বিষয়
বটে!
খালেদের হঠাৎ বিকালের কথা মনে পড়ল। অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখল।
ওফ ! কী কাণ্ডটাই না হল ! ওদের অর্থাৎ ৮-১০ বছর বয়সী বাচ্চাদের একটি নতুন এবং
প্রিয় খেলা ‘মিছিল করা’। বড়দের অনুকরণে ‘জয় বাংলা’, আমার নেতা তোমার নেতা, শেখ মুজিব
শেখ মুজিব’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ ইত্যাদি শ্লোগান ছাড়াও নিজেদের
আবিষ্কৃত কিছু কিছু শ্লোগান তারা দিয়ে থাকে। পাড়ার বড়রাও ওদের এই ব্যাপারটি খুব
উপভোগ করেন। কিন্তু ভুট্টোকে মিছিলে শামিল করা গেলেও ওর মুখ দিয়ে কোনদিন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান বের করা যায় নি। ওর আসল নাম
জুলফিকার আলী। বন্ধুরা নামের সাথে ভুট্টো যোগ করে দিয়েছে। এখন সেটাই নাম হয়ে গেছে।
ভুট্টোর বাবা লস্কর সাহেব ক’মাস
আগের নির্বাচনে বরিশালের কোথাও মুসলিম লীগ থেকে প্রার্থী হয়েছিলন। কিন্তু আ’লীগের প্রার্থীর কাছে হেরে যান।
ভুট্টো তাই ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান কক্ষনো দেয় না। সেই ভুট্টো
কী না আজ বিকালে ঘোষণা দিল যে, সে ‘জয়
বাংলা’ শ্লোগান
দেবে তবে ......। এমন এক কথা বলল যে ওরা সকলে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়। এমন মজার
শ্লোগান আর হতে পারে না, বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য। কারণ বাচ্চাদের খুব প্রিয় একটি
‘শব্দ’ শ্লোগানটিতে আছে। প্রচণ্ড
উত্তেজনায় তারা ঝটপট লাইনে দাঁড়াল, সবার সামনে ভুট্টো। গলা ফাটিয়ে ভুট্টো শ্লোগান
দিল ‘জয় বাংলা’। বাকিরা সবাই গলায় সবটুকু জোর ঢেলে
চীৎকার দিল ‘গু-য়ের
গামলা’ । আর যায়
কোথায় ? কয়েক দফা শ্লোগান দিতে না দিতেই পাড়ার বড় ভাইরা এবং মুরুব্বীরা সবাই হৈ হৈ
করে ওঠল। ভুট্টো ছাড়া সবাইকে একচোট বকা-ঝকা শুনতে হল। তারপর অবশ্য সবাই আদর করে
বুঝিয়ে দিল শ্লোগানটির খারাপ দিকগুলো। আচ্ছা, ওরা কি অত গভীর চিন্তা করতে পারে ?
ভুট্টোটা এমনি পাঁজি। সবাই যখন বকা শুনছিল, ও তখন এক ফাঁকে ফুড়ুৎ। আলম অবশ্য
খুব খেপেছে। ঘোষণা দিয়েছে, আজ রাতের মধ্যেই আগামীকাল ভুট্টোকে বকা খাওয়ানোর বুদ্ধি
বের করবে। দেখা যাক কাল কী হয় !......
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সাথে বাবার গলার আওয়াজ। খালেদ লাফিয়ে
ওঠে দরজা খুলে দেয়।
: কী রে আব্বু! এখনো ঘুমাস নি।
: ঘুম আসে না । তুমি আসছ না যে।
: যা, এখন ঘুমা।
খালেদ আবার শুয়ে পড়ে। হাত-মুখ ধুয়ে বাবা খেতে বসল, মা-র সাথে। দুজনেই
রাজনীতি নিয়ে টুকটাক কথা বলছে। খালেদ ওসব বুঝে না। গত কয়েক সপ্তাহে তার মাথায় কেবল
এ টুকুই ঢুকেছে যে রাজনীতি মানে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতা ধরে রাখা।এটা যারা চায়
তারা, এ কারণে দেশের কী ক্ষতি হল কিম্বা জনগণের বারোটা বাজল না কী তেরটা বাজল, ওসব
নিয়ে ধার ধারে না। চাই তারা সরকার হোক বা বিরোধী দল হোক। খানা শেষ হতেই বাবা আবার
শার্ট গায়ে দিল।
: খালেদের মা! তুমি শুয়ে পড়ো। দরজাটা ভেজানো থাকুক। আমি আসছি।
একথা বলে বাবা বেরিয়ে গেল। বাবা এখন হাসু কাকার টং দোকানে গিয়ে এক খিলি
আলিসান পান খাবে, খালেদ জানে।
খালেদের চোখ প্রায় লেগে এসেছিল, কিন্তু ছিটকিনির আওয়াজে তা
খুলে যায়। বাবা ফিরে এসেছে।
: কী ব্যাপার ! পান খেতে এত দেরী হল কেন ? মা উৎকণ্ঠিত স্বরে
জানতে চায়।
: লক্ষণ ভাল নয়, খালেদের মা। ইয়াহিয়া আর বঙ্গবন্ধুর বৈঠক
ভেস্তে গেছে। আর এই মাত্র স্বচক্ষে যা দেখে এলাম তাতে খুব অস্বস্তি বোধ করছি।
: কি দেখে এলে ?
: ক্যান্টনমেন্ট থেকে একের পর এক সৈন্য ভর্তি ট্রাক বের হয়ে
শহরের বিভিন্ন দিকে যাচ্ছে। প্রথমে খেয়াল করি নি। পরে আনমনে গোনা শুরু করলাম। ৪৬টা
ট্রাক গুনলাম। আসলে এর চেয়েও বেশী। অর্থাৎ ক্রেক ডাউনের মতলব আছে মনে হচ্ছে। :
বুঝলাম না। ক্রেক ডাউন কাকে বলে?
: এর মানে হচ্ছে এলোপাথাড়ি ধরপাকড় শুরু হবে। আর্মিরা সমানে
গুলি চালাবে।
: ধেৎ ! কি যে বল তুমি? নিজের দেশের লোকের ওপর গুলি চালাবে কেন
? এখন পর্যন্ততো আমরা পাকিস্তানি নাগরিক, আর ওরাও পাকিস্তানি সৈন্য।
: খালেদের মা! ঘোড়া হাসানো কথা বললে তুমি। তিনশ বছর আগের
চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তোমার মাথায়। তখন যুদ্ধ হত রাজায় রাজায়। এখন যুদ্ধ হয়
রাজায়-প্রজায়। কিন্তু প্রজার জান তখনও যেত, এখনও যায়। তফাৎ আগে রাজার জান যাওয়ারও
সম্ভাবনা থাকত, কিন্তু এখন শুধু প্রজার জানই যায়। অসহায় প্রজাদেরকে রাজারা যখন ইচ্ছা
তখন এক দফা পিটিয়ে নেয়। আর দেশের বাহিনীগুলো অর্থাৎ আর্মি- পুলিশ ইত্যাদি যারা
আছে, তারা খুশীমনে রাজার আদেশ পালন করে।
খালেদ চুপচাপ শুনে যাচ্ছে বাবার কথা। বাবা ইতিহাসের ছাত্র এবং
পোকা। গোটা দুনিয়ার ইতিহাস বাবার নখদর্পণে। যখন তখন ইতিহাসের যে কোন বিষয় নিয়ে
বাবা অনর্গল বলতে পারেন।
: তোমার বক্তব্যের পক্ষে কোন উদাহরণ দিতে পারবে?
খালেদের মা মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে।
: পারব মানে! উদাহরণ গুণে শেষ করতে পারবে? -৫২তে সালাম-বরকতকে
মারল কারা? এদেশের পুলিশরা নয়? ৬৬-র, ৬৯-র গণআন্দোলন দমন করতে কি ভিনদেশের
আর্মি-পুলিশ এসেছিল। আরো আগে যাও। ব্রিটিশ আমলে এদেশের জনগণের ওপর অত্যাচার
কি ব্রিটিশ পুলিশ করত না অন্য দেশের পুলিশরা করত? কম্যুনিস্ট দেশগুলোর দিকে তাকাও,
যখন তখন যাকে তাকে ধরে নিয়ে যায়, গুম করা হয়। এ কাজগুলো যে আর্মি পুলিশরা করে,
তারা কি ঐ দেশের না অন্য দেশের ? শুন ইতিহাসের কিছু common findings আছে। তার
মধ্যে অন্যতম এটা Every ruling party wants to eradicate its opponents অর্থাৎ
প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠী চায় তার বিরোধীদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে। এটা সত্য,
সর্বকালে, সকল দেশে। অতঃপর কেউ পারে, কেউবা ব্যর্থ হয়। ওটা ভিন্ন
ব্যাপার। কিন্তু শাসকের চরিত্রই হল শাসিতকে শোষণ করা, শেষ করা। এমন কি আমি যদি এখন
শাসক হই, আমার চরিত্রও এমনি হবে; তুমি হলে তোমারও হবে।
: থাক দরকার নাই তোমার আমার কারোরই শাসক বা শোষক হওয়া, আর
মজলুমদের বদদোয়া কামানো। কিন্তু যত বড় জালেম শাসক হোক, সকলেরই পতন হয়েছে। ইতিহাস
তো একথাই বলে, তাই না ?
: তা ঠিক। কিন্তু তারপরেও
ওদের হুঁশ হয় না। যেই লাউ, সেই কদু। দার্শনিক হেগেল ঠিকই ধরেছেন, ‘ইতিহাসের সব চাইতে বড় শিক্ষা হল:
ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ’
ব্যস! আজ রাতের জন্য সব বাদ দাও। এখন ঘুমাই।
* * * * *
গুলির প্রচণ্ড শব্দে খালেদের ঘুম ভাঙে। ধড়ফড় করে বিছানায় ওঠে
বসে। ভয়ে কাঁদছে খোকন আর আইরিন। আশেপাশে, ঘরের বাইরে অনেকের গলার আওয়াজ ;
ক্রন্দনরত এবং ভীত-সন্ত্রস্ত। দরজা খুলে খালেদের বাবা বাইরে উঁকি দিল। বাবা বাইরে
পা রাখা মাত্র খালেদ এক লাফে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। চারিদিকের আকাশ লাল হয়ে গেছে
আগুনের লেলিহান শিখায়। ক্ষণে ক্ষণে শুনা যাচ্ছে গুলির শব্দ আর আর্তনাদ। তাহলে
বাবার অনুমানই সঠিক হল ? সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরস্ত্র এবং
ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর । বাহাদুর বটে ! ভারতের কাছে প্রতিদিন মার খাস্। শরম নেই। অথচ
ঘুমন্ত মানুষ মারার বেলায় বহুত বাহাদুর। বাবার কথা মনে পড়ল, “ অন্যদেশের সাথে যুদ্ধ বাঁধলে আমাদের
সৈন্যরা হয় হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে নয় লুঙ্গী-গেঞ্জি পরে দিনমজুর সাজবে। কারণ ওরা
নিরস্ত্র জনতার ওপর অস্ত্র চালাতে তৃপ্তি পায়। ”
: ভাইসাবরা ! সকলে আমার বাসায় চলেন। সৈন্যরা এলে আমি কথা বলব।
আমার গায়ে হাত না দিয়ে আপনাদের কারো কোন ক্ষতি করতে পারবে না। লস্কর সাহেবর উঁচু
গলা শুনা গেল।
সবাই চুপ মেরে গেল। একজন শুধু বলল, লস্কর সাহেব! আপনি কেন
আমাদের জন্য এত ঝুঁকি নেবেন ? : আমি প্রতিবেশীর হক আদায় করতে চেষ্টা করছি মাত্র।
আর কিছু না। আর ঝুঁকিরও কিছু নেই। কারণ আমি মুসলিম লীগ করি।
: আমাদের এখানে প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ করে। তাদেরকেও আশ্রয়
দেবেন ?
: কেন নয় ? আপনারা যেটাই করেন না কেন, কিন্তু আমার প্রতিবেশী।
সুতরাং তাড়াতাড়ি করুন। পাড়ার মধ্যে হঠাৎ আর্মি ঢুকে পড়লে কিছু বলা-কওয়ার আগেই সবাই
মারা পড়ব।
: ঠিক আছে, দু মিনিটের মধ্যে আমরা সবাই আসছি। প্রায় সমস্বরের
জবাব।
খালেদ অন্তর থেকে উপলব্ধি করল যে এতদিন ধরে শুনে আসা কথাটা
তাহলে সত্যি অর্থাৎ ভুট্টোর বাবা আসলেই একজন ভাল মানুষ, যদিও ভুট্টোটা পাঁজির
একশেষ।
তারপর ? পাঁচ মিনিটের মধ্যে লস্কর সাহেবের দোতলা বাড়ীর পুরোটা
ভরে গেল। ১০-১২ টি পরিবারের শিশু থেকে বুড়ো, সকল সদস্য চলে এসেছে। দোতলায় ঠাই নিল
শিশু এবং মহিলারা। পুরুষরা এবং বালকরা আশ্রয় নিল নিচতলায়। খালেদ তার বাবার
সাথে জায়গা পেল নিচতলাতে। খালেদ শুতে জায়গা পেলেও তার বাবা বসেই রইল।
: দেখি, বাইরে কী অবস্থা। একথা বলে বাবা সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য
করে বারান্দায় চলে গেল। ক্লান্ত খালেদ টের পেল না যে, কখন সে ঘুমিয়ে গেল !
* * * * *
২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ সাল।
ঘুম ভাঙতেই চোখ পড়ল দেয়াল ঘড়িটার ওপর। প্রায় পোণে সাতটা বাজে।
বাবার কথা মনে হতেই লাফিয়ে ওঠে বসল। একজন বলল, খালেদের বাবা বাসায় গেছে। খালেদ রুম
থেকে বাইরে যেতেই তার মাকে দেখল দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নামতে। সাথে আইরিন, খোকনের হাত
ধরা। সকলে একত্রে বাসায় গেল । বাবাকে দেখতে পেল। ঘরের বারান্দায় বসে বাবা
পাশের বাসার রহিম চাচুর সাথে কথা বলছে। দু’জনেই
আতঙ্কিত।
সারাটি দিন এবং রাত ঘুমিয়ে আর ঘরে বসে পার করল খালেদরা, কারণ
কার্ফু ছিল। কথায় কথায় বাবা বলল যে, খালেদকে ঘুমাতে দেখে তিনি ছাদে চলে যান। ছাদে
ওঠতে না ওঠতেই শুনেন Hands Up. হাত তুলে দাঁড়ানোর পরে ২-৩টি কথায় বুঝে নেন যে ওরা
বাঙালী পুলিশ, তেজগাঁ থানায় ডিউটিতে ছিল। থানা আক্রান্ত হওয়ার পর পালিয়ে এসে এই
বিল্ডিঙয়ের ছাদে লুকিয়ে আছে। উদ্দেশ্য, যদি পাড়ায় পাকিস্তানী সৈন্য ঢুকে তাহলে
গুলি চালাবে। তাদের দুজনের হাতেই অস্ত্র ছিল। যে কারণে পাকিস্তানী সৈন্যদের ১৫-২০
জনের একটি দলকে দেখে তারা ‘রেডি’ হয়েছিল। কিন্তু বাবা বাঁধ সাধেন।
তিনি তাদেরকে বুঝাতে সমর্থ হন যে গোটা পাড়া এই ভবনটিতে আশ্রয় নিয়েছে। ৪-৫ জন
হানাদার হয়তো মারা যাবে, কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তানী সৈন্যরা এই মহল্লার একজনকেও
আস্ত রাখবে না। গোটা পাড়ায় হয়তো আগুন লাগিয়ে দেবে। প্রথমে দ্বিমত করলেও পরে বাবার
কথা মেনে নিয়ে তারা মত বদল করে। বাকি রাত তিনজনে গল্প করে কাটিয়ে দেয়। আযানের আধ
ঘণ্টা আগে তারা ছাদ থেকে নেমে অজানার উদ্দেশ্যে বিদায় নেয়। বাবার কাছে দোয়া চেয়ে
যায় যেন জালেমের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পিছ পা না হয়। কথাগুলো বলতে গিয়ে বাবা খুব
আবেগপ্রবণ হয়ে যান। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, মনে হচ্ছে মায়ের পেটের ভাইকে চিরবিদায়
দিয়ে এসেছি। ভাবছি তোমাদেরকে গ্রামে পাঠিয়ে আমিও যুদ্ধে যাবো। বদমাশ পাইক্কারা ’৪৭ এর শুরু থেকেই আমাদের উপর জুলুম
করে আসছে। আমরাও বার বার ভুলে গিয়ে পুনরায় মিলে মিশে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু
আর নয়। মাওলানা ভাসানি সাব যে কিছু দিন আগে ওদেরকে ‘ওয়া
লাইকুম সালাম ’ বলেছিলেন
সেটাই ঠিক।
* * * * *
২৭ শে মার্চ, ১৯৭১ সাল।
সকাল ৮টা হতে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত কার্ফু প্রত্যাহার করা হয়েছে।
রেডিওতে এই ঘোষণা শোনার সাথে সাথে যেন ঢাকার সব লোক রাস্তায় বেরিয়ে এল। উদ্দেশ্য
ঢাকা ছাড়া। প্রত্যেকে যে যার বাড়ীর পথ ধরল। ২৫ শে মার্চের মধ্যরাত থেকে ২৭শে
মার্চের সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে ঢাকাকে শ্মশানে পরিণত করা হয়েছে। অতএব,
এখানে থাকার কোন মানে হয় না। তবে যাবে কি করে ? যাতায়াতের যে কোন মাধ্যম
দুষ্প্রাপ্য। সকলে তাই পায়ে হেঁটেই রওয়ানা হয়েছে। যদ্দুর পারে যাবে, তারপর কোথাও
রাত কাটিয়ে পরদিন আবার হাঁটা শুরু করবে। দুপুর নাগাদ খালেদরাও বের হল।
সৌভাগ্যক্রমে একটি রিক্সাও পেল। তাতে করে চলে গেল সদরঘাটের কাছে, পাটুয়াটুলি। বেলা
সাড়ে তিনটার দিকে নাসের সাহেবের বাসায় ঢুকল। তিনি খালেদের বাবার এক সময়ের সহকর্মী।
ভদ্রলোক গণ্ডগোল আঁচ করে পরিবার-পরিজন মাস খানেক আগেই দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
আগামীকাল নিজেও চলে যাবেন।
রাতে খালেদের মা-ই রান্না করল। ভাত, মাসকলাইর ডাল আর আলুভর্তা।
খানাটা অনেক তৃপ্তিকর লাগল। আগামীকাল লঞ্চ না পেলে নৌকায় চড়ে দেশে যাবে। এত কষ্ট
আর শঙ্কার মধ্যেও খালেদের আনন্দ লাগছে। নৌকা ভ্রমণ ! তার খুব প্রিয় শখ। প্রফুল্ল
মনে খালেদ ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেল।
* * * * *
২৮ শে মার্চ, ১৯৭১ সাল।
কার্ফু ছাড়া হয়েছে সকাল ৮ টা –
দুপুর ১২ টা অর্থাৎ মাত্র চার ঘণ্টার জন্য। চটজলদি নাস্তা সারা হল। এখনি বাসায়
ফিরতে হবে। নৌ–ভ্রমণ হবে না!
কারণ ? খালেদের মা রাজি না। তার এক কথা, এত কষ্ট আমি করতে পারব না। বাসায় চল। মরণ
আসলে মরব। হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে, না হয় আমরাও মরলাম।
খালেদ তার মা-র বেঁকে বসার কারণ অনুমান করতে পারে। ইদানীং মা-র
চলতে-ফিরতে অনেক কষ্ট হয়। আর দু’মাস
পরে মা-র না কী একটা বাবু হবে, সবাই বলাবলি করে।রিক্সা পেতে বেশ কষ্ট হল। ঢাকার
ভেতরে কেহ আসতে চায় না, যদি ফেরত যেতে না পারে! দ্বিগুণের চেয়েও বেশী ভাড়ায় একজনকে
রাজি করানো গেল। সূত্রাপুর লোহার পুলে ভীষণ জটলা। খালেদের বাবা রিক্সা থেকে নেমে
কাছে গিয়ে দেখে আসল। নয়জন মানুষের লাশ! কৃষক শ্রেণীর। কয়েক ঘণ্টা আগে মারা হয়েছে।
গরীব মানুষ! ঘড়ি-টরি নেই। সময় আন্দাজ করতে পারে নি। কার্ফু ছাড়ার আগেই হয়তো ঘর
থেকে বের হয়ে পড়েছিল। পিশাচের দল গুলি করে মেরে ফেলেছে।
ঢাকার দিকের রাস্তা প্রায় খালি। গতকালের তিন ঘণ্টার রাস্তা আজ
এক ঘণ্টায় শেষ হয়ে গেল। খালেদরা তাদের ফার্মগেটের বাসায় ফিরে এল। পাড়ার
অর্ধেকের বেশী লোক গতকাল চলে গেছে। বাকীরাও আজ কালের মধ্যে চলে যাবার চিন্তায় আছে।
কোথায় ? কেউ জানে না, যদিও আপাতঃ ঠিকানা গ্রামের বাড়ী।
: খালেদের মা! অফিস থেকে একটা চক্কর দিয়ে আসি। রেডিওতে বার বার
কাজে যোগদান করতে বলা হচ্ছে। কাজ-তো হবে ঘোড়ার ডিম। তবে না জানিয়ে অনুপস্থিত থাকলে
মহা ঝামেলা। এই যাব আর আসব। ঘণ্টা খানেকের কাজ। কার্ফু আবার শুরু হতে আরো দু’ঘণ্টা দেরী। এই বলে বাবা বেরিয়ে গেল।
ছোট্ট খোকন ঘুমাচ্ছে। আইরিন যথারীতি পুতুল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে
পড়েছে। মা ভাত চড়াচ্ছে কেরোসিনের চুলায়। পেট বাবাজী তো আর কোন কিছু বুঝে না। সময়
হলে তার খানা চাই।
খালেদ উঠোনে হাঁটাহাঁটি করছে। তার সমবয়সী আছে, এমন পরিবারগুলো
কাল চলে গেছে। যে কয়টি পরিবার বাকি আছে, সেখানে সবাই তার বড় অথবা অনেক ছোট। মহা
মুশকিল! কারো সাথে যে গল্প করবে, কালকের দিনটি কার কেমন গেছে, জেনে নেবে সে উপায়
নেই। আচ্ছা, ভুট্টোরা তো এখনো আছে। যাবে না কি ওদের বাসায় ? আম্মুকে বলে যাই, নচেৎ
পেরেশান হয়ে যাবে।
কিন্তু খালেদের ভুট্টোদের বাসায় আর যাওয়া হল না। ও কী!
ওরা কারা ? উঠোনের দক্ষিণ দিকের গলি দিয়ে ঢুকে তীরের মত সাঁই করে পশ্চিমের
গলি দিয়ে বের হয়ে গেল। খালেদ এক ঝলক দেখল মাত্র।
একটি ছেলে আর তার কয়েক কদম পেছনে একটি মেয়ে। কলেজে
পড়ুয়াদের বয়সী হবে। উভয়ের পরনে দৌড়ের ড্রেস। দুজনেই এত জোরে দৌড়াচ্ছে যে ওদের
স্কুলের দৌড় চ্যাম্পিয়ন হাবলু ভাইও নির্ঘাত হার মানত।
খালেদের বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেল যখন দেখল একদল শয়তান অর্থাৎ
সৈন্য হাঁপাতে হাঁপাতে দক্ষিণের গলি দিয়ে উঠোনে ঢুকল। শয়তানগুলো ভয়ংকর রকম
উত্তেজিত। মুখ দিয়ে মেশিনগানের মত গালি ছুটছে। খালেদ শুধু ‘কিধার যায়েগা, কাঁহা যায়েগা, উসকো
পাকড়াও’ ‘...আগ লাগা দো’ এই টুকু বুঝতে পারল। শয়তানদের
হাঁকডাক শুনে পাড়ার মুরুব্বীরা ঘর থেকে বের হয়ে এল। মুরুব্বীদের সাথে চিল্লাচিল্লি
করে শয়তান গুলো চলে গেল । সকলের মুখ কাল হয়ে গেছে। এমন সময় বাবা ফিরে এল।
অন্যান্যদের কাছ থেকে বাবা ঘটনা জেনে নিল। ঐ ছেলেটি আর মেয়েটি ফার্মগেটের মোড়ে
দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা হাতে ‘জয়বাংলা’, ‘জয়
বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান
দিয়েছে । পাকিস্তানী সৈন্যরা ওদেরকে দৌড়ে ধরতে চেয়ে পিছু পিছু আসে । কিন্তু এখান
থেকে হারিয়ে ফেলে। পাড়ার লোকেরা যদি ওদেরকে ধরে না দেয় তবে আগুন লাগিয়ে গোটা
পাড়া জ্বালিয়ে দেবে। ওরা আবার তিন ঘণ্টা পর আসবে।
এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ! বেলা বাজে এগারটার ওপরে, কার্ফু
শুরু হবে ১২ টায়। কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে ঐ দুই যুবক-যুবতীকে ? আর পাওয়া গেলেই বা
ওদেরকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেবে কেন ? হোক বোকামি, কিন্তু এমন বীরত্বের কাজ
এমন দিনে আর কে করেছে ? অতএব, উপায় একটাই। বাসা ছাড়ো, পাড়া ছাড়ো। ঝড়ের গতিতে
ঘর দুয়ার বন্ধ করে সবাই সপরিবারে বের হয়ে যেতে লাগল। খালেদের আব্বাও তাই করল।
আবার শুরু হল পথচলা।
কাঠ ফাটা রোদ। বেলা সাড়ে এগারটা। খালেদের অনেক কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু সব কষ্ট সে ভুলে যায় যখন দেখে বাবা ছোট্ট খোকনকে কোলে নিয়ে হাঁটছে আর
ঘামছে। আর মা! অসুস্থ মা যেন ঘোরের মধ্যে পা ফেলছে। মা-র হাত ধরে হাঁটছে খালেদের
ছোট বোন আইরিন।
রাস্তাঘাট প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। স্যাৎ করে ধুলো উড়িয়ে পাশ
কাটিয়ে চলে গেল একটি ট্রাক, ভেতরে এক পাল জানোয়ার। খালেদ মনে মনে স্থির করেছে যে,
ওদেরকে আর কোনদিন সৈনিক বলবে না। ওরা খবিস, শয়তান, নরাধম, হিংস্র পশু। ওদের জন্যই
আব্বু-আম্মু আর তার নিজের এত কষ্ট। দু চারটে জানোয়ারকে যদি কোনভাবে বধ করা যেত!
ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মত ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। তারপরে
সুযোগ মত জানোয়ার জবাই করা যাবে।ওটা নিশ্চয় তেমন কঠিন কিছু হবে না। ছ’মাস আগেই সে মুরগী জবাই করতে
শিখেছে। খালেদের রক্তে বান ডাকে! ঐ বান তাকে চলার শক্তি যোগায়।
একটি বিশাল গেটের সামনে খালেদের আব্বা থামে। গেটের ভেতর থেকে
দারোয়ান বের হয়ে এসে “স্যার!
তাড়াতাড়ি ঢুকুন।” বলে গেট
খুলে দেয়। সকলে ঢুকার পরে আবার গেট বন্ধ করে দেয়।
খালেদরা এখন ‘
তেজগাঁও সিভিল সাপ্লাইর ’ সংরক্ষিত
এলাকার ভেতরে। গোটা এলাকাটি একটি বাড়ীর মত। এখানে আছে খাদ্য বিভাগের নিজস্ব গুদাম
এবং বাসা। কিন্তু খালেদের বাবার নামে কোন বাসা বরাদ্দ নেই। তাই তারা এলাকার বাইরে
ভাড়া বাসায় থাকে।
সংরক্ষিত এলাকা বলে ধরে নেয়া যায় যে, খালেদরা আপাততঃ ঘরের
ভেতরে আছে। কার্ফু ভঙ্গের অপরাধে ওদেরকে হয়তো বা পাকড়াও করা হবে না। কিন্তু তারা
যাবে টা কোথায় ?
খালেদ তাকায় বাবার মুখের দিকে। দেখে, সেখানে অসহায়ত্বের ছাপ।
তাকায় মা-র মুখপানে। সেখানে দেখে হতাশার নিবিড় অন্ধকার। অথচ এই দুটি চেহারাই এতদিন
যাবৎ খালেদের যাবতীয় শক্তির উৎস। কিন্তু এখন ? .........
: আম্মু ! আর হাটতে পারছি না। পা ব্যথা করে। কান্না জড়িত কণ্ঠে
আইরিন বলে ওঠে।
: এই-তো, মা! এখনি বসব ঐ গাছটির তলে। বাবা সান্ত্বনা দেয়
আইরিনকে।
প্রায় শ’
খানেক হাত দূরে একটু ফাঁকা জায়গা। বেশ কয়েকটা আম কাঁঠালের গাছও আছে। খালেদরা
সেখানে এসে থামল। তারপর বসে পড়ল গাছ গাছালির নীচে।
কিন্তু রওনা হওয়ার সময়ে এটা যে গন্তব্য ছিল না, সেটা খালেদ
বোঝে। তাহলে ? এই চলার শেষ কোথায় ? খালেদ জানে না। তার বাবা-মা কি জানে ? চেহারা
দেখে বুঝা যায় যে তারাও জানে না। জান বাঁচানোর তাগিদে উপস্থিত পথে নেমেছে, কোন
ঠিকানা নির্দিষ্ট না করেই। তবে কি এটা ‘ঠিকানাবিহীন’ এক পথ চলা ?
* * * * *
পড়তে পড়তে ক্লান্ত খালেদ ডায়েরীটা বন্ধ করে চোখ বুজে থাকে।
লেখার শেষে প্রশ্নটা তাকে ভীষণ নাড়া দেয়। অবস্থাটা কি এতদিনে আদৌ পাল্টেছে ? মনে
তো হয় না, যদিও স্বাধীনতার পর প্রায় পঞ্চাশটি বছর হতে চলল।
লেখক:
মোহাম্মদ সালেক পারভেজ
সহকারী অধ্যাপক,
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.bd
প্রথম প্রকাশঃ ২৬ ও ২৭ মার্চ ২০১৫ ধারাবাহিকভাবে দুই পর্বে breakingnews.com.bd ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
লিঙ্কঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন