-->

তবে একলা চলো রে


ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। ব্যক্তিগত রুমে নির্দিষ্ট চেয়ারে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে বসে আছি। তসলীম আরেফীন, ভার্সিটির দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক, ক’দিন ধরেই তাড়া দিচ্ছে একটা লেখা দেবার জন্যে। দেখেছে যে, আমার এক-আধটু লেখালেখির অভ্যাস আছে। তাকে খুশি করার জন্য ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছি। কিন্তু ‘লিখবটা’  কী?  না আমি পেশাদার লেখক, না আমার আছে নজরুলের মতো প্রতিভা যে কলম ধরলেই হড় হড় করে লেখার ফোয়ারা ছুটবে! ভাবছি আর ভাবছি। ভাবতে ভাবতে ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছি। কখন যে চোখ দুটো বুজে এল টের পেলাম না।



: আসসালামু আলাইকুম।
বয়স্ক গলায় সালামের শব্দে চমকে উঠলাম। বেশ বয়স্ক দু’জন ভদ্রলোক প্রায় একসাথে রুমে ঢুকলেন। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবী। বয়সে আমাদের সাবেক উপাচার্য মহোদয়ের সমবয়সী হবেন। সম্মান প্রদর্শনের জন্য দাঁড়িয়ে দুটো চেয়ার এগিয়ে দিলাম।
মুখে সালামের প্রত্যুত্তর দিয়ে ভাবতে থাকলাম কারা হতে পারেন! ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক হিসাবে  বড় ভাই-বোন কিম্বা বাবা-মা এসে থাকেন। কিন্তু কারো দাদা-নানা কে তো আজ অবধি আসতে দেখি নি।  
: বোধ হয় চিনতে পারছেন না। একজন বললেন।
: সত্যি দুঃখিত। মৃদু হেসে অপারগতা প্রকাশ করলাম।  
: দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আগে তো আর দেখেন নি যে চিনতে পারবেন। তবে পরিচয় দিলে খুব সহজেই চিনবেন। অন্তত এই ফেব্রুয়ারি মাসে। 
: মানে! চিনবো না আবার ফেব্রুয়ারি মাস হওয়ার কারণে চিনবো! 
অবাক হয়ে বলি।
: আমার নাম সালাম আর উনি বরকত ভাই। 
: কোন সালাম-বরকত? একুশে ফেব্রুয়ারীর...
: হ্যাঁ ভাই, আমরাই। ঐ তো যাদেরকে নিয়ে আপনারা গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি লিখেছেন, লিখছেন এবং ভবিষ্যতেও লিখবেন। বরকত ভাই বললেন একটু শুকনো হাসি দিয়ে।  
আমার চক্ষু  চড়ক গাছ। বিস্ময় মাত্রা ছেড়ে গেছে। স্বপ্ন দেখছি না তো! আবার নিজকে মহা সৌভাগ্যবানও মনে হচ্ছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মোলাকাত পেয়েছি! পলকহীন নেত্রে তাকিয়ে আছি। উনারাও এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। সম্ভবত হাল আমলের একটি অফিস কক্ষের সাথে ষাট বৎসর আগের অফিস কক্ষের মিল-অমিল দেখছেন। ডেস্কটপটাকে একটু বেশি মনযোগ দিয়েই দেখলেন। অন্যকেউ হলে হয়তো জ্ঞানদান করতাম। কিন্তু ইনাদের সামনে সে সাহসই হলো না। খেয়াল করলাম যে, যিনি বরকত ভাই তিনি আনমনে মাঝে মধ্যে গুন-গুন করছেন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না— আসে, তবে একলা চলো রে...।”
গলাটাও বেশ চমৎকার। 
হতবিহবল ভাবটার রেশ কাটাতেই স্বব্যস্ত হয়ে উঠি। 
: আপনাদের জন্য কী মেহমানদারী করতে পারি ?
: বসুন, ব্যস্ত হবেন না। আমরা মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য এসেছি। দেখা না পেলে এক মুহূর্তও দেরি না করে চলে যেতাম। আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে। 
: কিছু মনে না করলে, একটা কথা বলি। আপনাদেরকে খুবই উত্তেজিত মনে হচ্ছে।
বেশ সমীহের সাথে কথা কয়টি বললাম। যারা ইতিহাসের স্রষ্টা, তাদের সামনে কে না সঙ্কুচিত হয়!   
: ঠিক ধরেছেন। তবে আমরা কেবল উত্তেজিতই নয়। আমরা রাগান্বিত, শঙ্কিত এবং হতাশাগ্রস্ত।
দু’জন একই সাথে বলে বসলেন।
থতমত খেয়ে গেলাম। ভয়ে ভয়ে জানতে চাই, কারণটা একটু ব্যাখ্যা করবেন কি? 
: কারণ তো প্রকাশ্য। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে কি? আপনারা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক তারা  যদি না দেখেন, তবে দেশের আমজনতা দেখবে কেমন করে? 
একটু রোষের সাথে বললেন বরকত ভাই।
: তবুও যদি আরেকটু ব্যাখ্যা দিতেন...।
আমতা আমতা করি। এতো বড় ব্যক্তিত্বের সামনে বসে মাথা ঠিক মত কাজ করছে না। 
: ঠিক আছে আমি সহজ করে বলছি। একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে চেয়ারটা টেনে এগিয়ে বসলেন সালাম ভাই। নামে-কামে-চেহারায় বেশ মিল আছে। সালাম ভাইকে দেখলেই বোঝা যায় যে শান্ত মানুষ। বলতে শুরু করলেন।
  
:৫২’র ভাষা আন্দোলন কেন হয়েছিল? বৎসরে একদিন মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য? না কি বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করার জন্য? আন্দোলনের স্লোগানটা কি মনে আছে? ‘ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’— এটা নয় ? সেই মিশন কি সফল হয়েছে? সফল হওয়াতো দূরের কথা, ক্রমে ক্রমে তা ম্রিয়মাণ। জাতীয় পর্যায়ে আজ বাংলা ভাষা বিতাড়িত। পথে-ঘাটে আজ বাংলা নেই। ঢাকা শহরে যতো সাইনবোর্ড দেখলাম, তার বার আনি ইংরেজিতে লেখা। আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের তিনটে শব্দের প্রত্যেকটি ইংরেজির। এখানে দাপ্তরিক সকল কাজ কাম করা হয় ইংরেজিতে। ছাত্ররা পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং, কিন্তু আপনারা মাথায় তোলেন যদি ভালো ইংরেজি পারে। হপ্তায় দু’দিন ঠিক করেছেন সকল কাজ ইংরেজিতে করার জন্য, বাংলার জন্য পারেন নি একটা দিনও বরাদ্দ করতে। শুধু আপনাদেরকে দোষ দিলে অবশ্য অন্যায় হবে। গোটা সমাজের একই হালচাল। বাবা-মাকে দেখছি পেরেশান সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর জন্য। সবচে বড় কথা  ইংরেজিকে যদি কেবল ভাষা হিসাবে শিখতেন, আপত্তি ছিলো না। কিন্তু ইংরেজি শিখছেন ইংরেজ হবার উদ্দেশ্যে, সোজা কথায় ইংরেজদের গোলামি করার মতলবে। যে কারণে ব্রিটিশ পিরিয়ডে ইংরেজি শিখা হতো। লর্ড মেকলে ঘোষণা দিয়েছিলো যে ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য এমন একটা জনগোষ্ঠী তৈরি করা যারা হবে  Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, and in intellect. মেকলের মনোবাঞ্ছাই পূর্ণ করার জন্য আপনারা উঠে-পড়ে লেগেছেন। সেই মানসিক গোলামদের সংখ্যাই দিনের পর দিন বাড়ছে। অথচ সবাই ভুলে বসে আছে ‘৫২র ভাষা শহীদদের কোরবানির ইতিহাস এবং উদ্দেশ্য।

একদমে এতগুলো কথা বলে হাঁপাতে লাগলেন বুড়ো মানুষ সালাম ভাই। বোঝা যায় কথা শেষ হয়নি। জিরোচ্ছেন। আবার শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।     
ক্রিং ক্রিং ...। 
টেলিফোনটা বাজছে।  
: মাফ করবেন, সালাম ভাই। ফোনটা একটু ধরতে হয় যে।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন উভয়ে।
হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরলাম। 
এ কী! চেয়ার খালি কেন ? কোথায় গেলেন দু’ ভদ্রলোক ? বিদায় না নিয়ে চলে গেলেন ? এটা কেমন করে হয় !
তবে কি ঘটলো এতক্ষণ!
স্বপ্ন?
অবচেতনা?
কল্পনা?
থাক, পরে চিন্তা করা যাবে। আপাততঃ ফোনের ঝামেলাটা সেরে নিই। 

লেখক:

মোহাম্মদ সালেক পারভেজ

সহকারী অধ্যাপক
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি, ঢাকা ১২০৭  
ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.bd

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ 

প্রথম প্রকাশঃ
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
http://ebanglanews24.com/Bangla/detailsnews.php?nssl=200773d6873bb9d8cc8e2433492f4600&nttl=21032013183263

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন