-->

জয় পরাজয়

অপরূপ সুন্দর এক বন! এত বেশী সুন্দর যে একবার এক মানুষ সে বনে ঘুরতে গিয়েছিল। সে এতই মুগ্ধ হয়েছিল যে, প্রাণমাতানো এক কবিতা লিখে ফেললঃ
কোন্ বনেতে জানি নে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল,
কোন্ গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে।
আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো,
ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে॥
শুধু যে প্রাকৃতিক ভাবে সুন্দর তাই নয়, বনের বাসিন্দারাও খুব ভাল। বনে কোন বাঘ- ভাল্লুক-সিংহ নেই, আছে প্রধানতঃ গরু-মহিষ-ভেড়া-ছাগল। আর আছে অনেক অনেক হরিণ। দু’ চারটে ঘোড়াও আছে। একটি ঘোড়া খুবই দুরন্ত দুর্বার। ওটাকে বাকিরা রাজা হিসাবে মেনে নিয়েছে। ঘোড়া যেহেতু তৃণভোজী প্রাণী, তার দ্বারা কারো আক্রান্ত হওয়ার আশংকা প্রায় শূন্য ।


এ সকল বাসিন্দাদের পরস্পরের মধ্যে কোন হিংসা বিদ্বেষ নেই, আছে কেবল সৌহার্দ্য ।
সবাই মিলে মিশে এক ঘাটে পানি পান করে। বনের মাঝে দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল এক চারণভূমি। সেখানে সবাই সকাল-সন্ধ্যা খায়-দায়, গপ্প-গুজব করে। তারা এমনি বেখেয়াল যে বনের অন্যত্র কোথায় কি ঘটে তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই।
তবে ষোল আনা সুন্দর বলে পৃথিবীতে কোন কিছু নেই। ঐ বনেও আছে বন্য কুকুর, শুকুর আর হিংস্র হায়েনা । এরা মাঝে মাঝে এক আধটু উৎপাত করে এই যাহ।
ও, হ্যাঁ। একটি কথা বলতে ভুলে গেছি। বনে ঝোপ ঝাড় থাকবেই। আর যেখানে ঝোপ ঝাড়, সেখানে সাপ বিচ্ছু থাকাটাই স্বাভাবিক।
এই অসাধারণ বনটির নাম ‘সুন্দরবন’।
আর তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এটা কিন্তু বাংলাদেশের সেই বিখ্যাত ‘সুন্দরবন’ নয়। কারণ বাংলাদেশের ‘সুন্দরবনে’ অনেক ‘সুন্দরী’ গাছ আছে। আর আমাদের এই ‘সুন্দরবনে’ একটিও ‘সুন্দরী’ গাছ নেই।

বনের এক পাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে গভীর খরস্রোতা ‘মায়াবিনী’ নদী।
নদীর অপর পাড়ে অন্য একটি বন। এটা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির । রীতিমত গা ছম ছম করা গভীর অরণ্য । বন্য, ভয়ংকর এবং কুৎসিত বলতে যা বুঝায় তার সবকিছু এখানে আছে।এই বনের রাজা এক বুড়ো রাক্ষস। বুড়ো মানে ভালই বুড়ো। কয়েকবার হার্টের অপারেশন হয়েছে। চমকে ওঠার কিছু নেই। রাক্ষসরাও আজকাল বেশ ভাল ডাক্তারি শিখছে। ওদের মধ্যেও অনেক M.D., M.R.C.P., F.C.P.S. ইত্যাদি আছে। যাক সে কথা। বয়সের ভারে দুর্বল হলে কী হবে, রাক্ষসটার রাক্ষুসে চরিত্র কিন্তু একটুও পাল্টায় নাই।
সারাক্ষণ কেবল খাই খাই ভাব। তার এই স্বভাবের কারণে কত জনে যে কত ভাবে বিপদে পড়ছে তা লিখতে গেলে নতুন এক ‘মহাভারত’ রচিত হয়ে যাবে।
তবে এটা শুনে সবাই আশস্থ হতে পারে যে রাক্ষসটা ইদানীং বেশ দুশ্চিন্তায় আছে। এর পেছনে বড় বড় দু’টো কারণ আছে। একটি পারিবারিক, অন্যটি রাষ্ট্রীয়।

পারিবারিক সমস্যাটি বেশ মজার। রাক্ষস রাজার দুই সংসার। প্রথম বউ মারা যাবার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আর এমনতর অবস্থায় যা স্বাভাবিক তাই হচ্ছে। দু সংসারে অমিল লেগেই আছে।
রাক্ষসদের মধ্যে বিভিন্ন ভাগ আছেঃ রাক্ষস, খোক্কস, বোক্কস এবং হোক্কস ইত্যাদি। (এটা তেমন বড় কিছু না। মানুষের মধ্যে যেমন বাঙালী, পাঠানি, জাপানি, ইরানি, চাকমা, আফ্রিকান ইত্যাদি বলতে যেরূপ বুঝায় অনেকটাই তদ্রুপ।) এদের মধ্যে রাক্ষসরা গায়ে গতরে সবচে বড় হয়। সর্দারিটা তাই ওদের হাতেই থাকে। খোক্কসরা ‘রবোটিক’ চরিত্রের। চোখ বন্ধ করে হুকুম তামিল করে। সেনাবাহিনীতে ওদের অনেক কদর। বোক্কসরা বোকা সোঁকা । অন্যান্যদের কামলাগিরী করেই এরা জিন্দেগী পার করে। আর হোক্কসরা সবচে ছোট-খাট গড়নের, অলস প্রকৃতির। মেয়ে হোক্কসরা ‘ডাইনি’ নামে কুখ্যাত।

রাক্ষস রাণী হটাৎ মারা যাওয়াতে রাক্ষস রাজা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। রাজ্যের বিশিষ্ট ডাক্তাররা ( ওরাও কিন্তু রাক্ষস) রাজকার্য হতে কিছু দিনের জন্য বিরতি নিয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর পরামর্শ দেন । সেজন্য রাজা এসেছেন ভয়াল বনের প্রান্তসীমায় ‘মায়াবিনী’ নদীর পাড়ে। স্বল্প সময়ের মধ্যে রাজার শারীরিক এবং মানসিক উন্নতি শুরু হয়। মনের বিমর্ষতা কাটতে থাকে। একদিন ঘুরতে ঘুরতে এক ডাইনির দেখা পান। প্রথম দেখাতেই রাজার পছন্দ হয়ে যায়।
ডাইনি বেচারীর হোক্কস স্বামীটা মারা গেছে কিছুদিন আগে। এতে ডাইনির মনে কোন দুঃখ নেই। বেটা এক সময়ে অনেক জ্বালাত, এমনকি গায়ে হাত পর্যন্ত তুলত। তবে শেষকালে সেও শোধ নিয়েছে। মাঝে মধ্যে আচ্ছা করে ধোলাই দিয়েছে। মিনসে মরেছে, ভাল হয়েছে।

আপদ গেছে। তবে তার দুঃখ অন্য কারণে। পেটের ছেলেটাকে নিয়ে। মনে করেছিল বাপের মত মেধাবী হবে। এটা সে স্বীকার করে যে হোক্কস স্বামীটার মেধার তারিফ সবাই করত। কিন্তু পোলাটা বাপের মেধা কিছুই পায়নি। বরং পেয়েছে মামাদের ধান্ধাবাজী চরিত্র। ওতেও চলত। সর্বনাশ ষোলকলায় পূর্ণ হল যখন কিছু বানরের সাথে সখ্যতা করল। বানরগুলোর কাছ থেকে কী এক ‘ডাইল’ খাওয়া শিখল। এখন ওটা খেয়ে যেখানে সেখানে ‘টাল’ হয়ে থাকে। খোক্কসদের হাতে কত বার যে প্যাঁদানি খেয়েছে তার হিসাব নেই। আচ্ছা ‘ডাল’ তো সেও জীবনে অনেক খেয়েছে। মসূর, মুগ, বুট, অড়হর ইত্যাদি কত রকমের ‘ডাল’ খেয়েছে; তা-ও আবার গোটা ডেগ ভর্তি! কৈ , কোনদিন তো টাল হয়নি। আসলে আজকাল কার হোক্কস তো! অকম্মার ধাড়ী। সারাজীবন বাবা-মায়ের ঘাঁটের পয়সায় চলতে চায়।
ডাইনি সারাদিন মায়াবিনী নদীর পাড়ে বসে থাকে আর এ সমস্ত আবোল-তাবোল চিন্তা করে। আর ভাবে নদীর ওপারে অবস্থিত ‘সুন্দরবনের’ কথা। তার বড্ড শখ হয় সুন্দরবনে গিয়ে থাকতে। তার পূর্বপুরুষরা না কি ঐ বনেই থাকত। বাকীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত জুলম করার কারণে সবাই একজোট হয়ে তাড়িয়ে দেয়। এটা কথা হল ? হোক্কসরা কি ফেরেশতা ? হোক্কসরা জুলম করবে না তো করবে টা কে ? ওদের কাজ-ই তো এটা। এপার থেকে কিছু সাহায্যকারী পাওয়া গেলে ওপারে গিয়ে দেখিয়ে আসত জুলম কারে বলে । তেমন দিন কি আসবে কোনদিন ?
এমন এক দিনে দেখা হয় রাক্ষস রাজার সাথে। নদীর পাড়ে রাজা পায়চারী করছিলেন। তাকে দেখে রাজকীয় গাম্ভীর্যের সাথে এগিয়ে আসেন। ডাইনি তাড়াতাড়ি কুণ্ঠিত ভাবে ওঠে দাঁড়ায়। রাজা মশাই তিন চারটে কথা জিজ্ঞাসা করেন। ডাইনি জড়সড় ভাবে জবাব দেয়। রাজা মশাই চলে গেলেন।ডাইনির বিস্ময়ের ঘোড় কাটে না। কিন্তু দু’দিন পর! বিস্ময়ের পর বিস্ময় !! রাজা মশাই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। নিজের কপালকে বিশ্বাস করতে ডাইনির নিজেরই কষ্ট হচ্ছিল। বিয়ে হয়ে গেল যথাসময়। ডাইনির ঠিকানা হল রাজপ্রাসাদে, রাণী হিসাবে।

ডাইনির এখন ছেলেটাকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না। যতই টাল হোক, যেখানেই শুয়ে থাকুক, তাকে আর কেউ এখন প্যাঁদানি দেয় না। বরং যত্ন করে নিরাপদ স্থানে এনে রেখে দেয়। তবে সুন্দরবন নিয়ে ডাইনির আফসোস এখনও কাটেনি।

* * * *

: মহারাজ, আজকাল আপনাকে একটু বেশী বিষণ্ণ লাগে। অনুগ্রহ করলে কারণটা জানতে পারি। স্বামীর চিন্তাক্লিষ্ট চেহারার দিকে তাকিয়ে ডাইনি রাণী মন্তব্য করে।
: হ্যাঁ, রাণী তুমি ঠিকই ধরেছ। বয়স তো হল, কবে কোনদিন মরে যাই তার ঠিক নেই। অথচ অনেক অনেক দিনের একটি আশা আজো বাস্তবায়ন করতে পারলাম না।
: ছিঃ, এমন অলক্ষুণে কথা বলতে নেই মহারাজ। আপনি দীর্ঘজীবী হউন। কিন্তু দুঃখটা কি জানতে পারি?
: অবশ্যই। সেটা হল ‘সুন্দরবনকে’ নিয়ে। এটাকে আজো গিলতে পারলাম না। অথচ এত্থেকে বড় কত কিছু হজম করে ফেললাম। রাক্ষস রাজা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
: জি, মহারাজ। আপনার জন্য এটা অনেক কষ্টের ব্যাপার। তবে পারছেন না কেন ? এটা আমার বুঝে আসছে না। সুন্দরবনের বাসিন্দারা নিরীহ প্রকৃতির। আপনার বিপুল পরাক্রান্ত বাহিনী নিয়ে একটা আক্রমণ চালালেই তো কাজ হয়ে যায়।
: হয় তো বটে, তবে আমি জিততে চাই at zero cost. ওদের লাখ মরলে আমার তো শত মরবে। এটাও আমি চাই না। তাছাড়া গরু-মহিষ-ছাগল-হরিণের শিং কে রাক্ষস খোক্কসদের ভীষণ ভয়। পাছে যদি পেট ফুটো হয়ে যায়। এর ওপর আছে ঘোড়ার লাথি।
: এটা কি করে সম্ভব ? যুদ্ধে জিতব, অথচ কোন ক্ষয় ক্ষতি হবে না!
: সম্ভব রাণী, সম্ভব । আজকাল হর হামেশা এটা ঘটছে। আমি মনুষ্য জগতের খবরাখবর রীতিমত রাখি। মানুষদের ইতিহাস নিয়ে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। সেখানে দেশ দখলের অনেক ঘটনা পড়েছি যেখানে দখলকারীর ধরতে গেলে কোন ক্ষতিই হয় নি।
: কিন্তু কিভাবে ? মানুষদের নিয়ে আমারও বেশ কৌতূহল। তাই কিছু পড়াশুনা আমিও করছি। কিন্তু বিষয়টি এখন পর্যন্ত বোধগম্য হয় নি।
: ওটা সম্ভব হয় যদি কোন এক স্থানের বাসিন্দাদের পরস্পরের মধ্যে বিবেধ সৃষ্টি করা যায়।
রাজার কথায় কীসের যেন ইঙ্গিত! ডাইনির ক্ষুরধার মস্তিষ্ক দ্রুত গতিতে কাজ করছে। হঠাৎ ধরতে পারে সেটা।
: মহারাজ একটি কথা। আমাকে দায়িত্বটা দিন। আমি সুন্দরবনকে আপনার সাম্রাজ্য ভুক্ত করে দিচ্ছি।
: বুঝে শুনে বলছ তো ? পারবে তো ? এর আগে অনেক বড় বড় কূটনীতিক ও সমর বিশারদরা কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।
: তারা না পারুক, তবে আমি ঠিক ঠিক পারব। কিন্তু দুটো শর্ত আছে।
: কি কি শর্ত ?
: প্রথম শর্তঃ প্রয়োজনীয় logistics support চাওয়ামাত্র যেন পাই। দ্বিতীয় শর্তঃ দখলের পর সেটার কর্তৃত্ব আমাকে দিতে হবে। আমার পর আমার সন্তানরা, এভাবে বংশ পরস্পরা চলতে থাকবে।
: উভয় শর্ত মঞ্জুর করা হল। আমি চাই পৃথিবীতে রাক্ষসদের রাজত্ব বিস্তৃত হোক। তুমি যেভাবে ইচ্ছা শুরু করতে পার।
: তাহলে এ মুহূর্ত থেকে সুন্দরবন সংক্রান্ত যাবতীয় দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। দেখবেন কিছুদিনের মধ্যে ওটা ভয়াল বনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। এবার
ঘুমাতে পারেন।
বক্তব্য শেষ করে রাণী রাজার দিকে তাকিয়ে একটি মহব্বতের হাসি দিল। পিলেচমকানো
সেই বিটকেলে হাসি দেখে মহা প্রতাপশালী রাক্ষস রাজার কলজে পর্যন্ত হিম হয়ে গেল।

* * * *

কোন এক ছুতোয় ডাইনি সুন্দরবনে প্রবেশ করল। সাথে সেবকের পোষাকে গেল বেশ কিছু খোক্কস। সুন্দরবনে তারা একটি আশ্রম খুলল। সুন্দরবনের বাসিন্দারা কিছুটা কৌতূহলে এবং কিছুটা প্রয়োজনে সেই আশ্রমে ঢুঁ মারতে লাগল। কিন্তু সেবা চিকিৎসা ইত্যাদির পাশাপাশি আশ্রমে চলত নিয়মিত মগজ ধোলাই। ডাইনি তার সাথীদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছিল যে একটি মিথ্যাকে শত-সহস্র বার বলবে ; এক পর্যায়ে ওটাকেই সবাই সত্য বলে ধরে নেবে। এই মগজ ধোলাইয়ের ফল পাওয়া গেল।
অচিরেই সুন্দরবনের বাসিন্দাদের থেকে বন্য কুকুর, শুকর আর হিংস্র হায়না এবং বিষাক্ত সর্প সমূহের সমন্বয়ে একটি দল তৈরি হল যারা ভাবতে এবং বলতে লাগল , সুন্দরবন আর ভয়াল বনকে একত্রিত করা হোক। এতে এক বিশাল মহা অরণ্য পাওয়া যাবে, যেখানে সবাই উন্মুক্ত মনে ইচ্ছেমত ঘুরতে পারবে।
কিন্তু সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করে উঠল সুন্দরবনের ঘোড়াগুলো। তবে রাজা ঘোড়াটার বদ নসীব। অসুস্থ হয়ে একদিন সে আশ্রমে গেল। আর পায় কে ? রাণীর ইঙ্গিতে খোক্কস গুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘোড়াটার ওপর। বেচারা প্রাণপণে জুঝল। পায়ের লাথিতে তিনটে খোক্কসের দাঁত-চোয়াল ভাঙল, একজন আবার জায়গাতেই অক্কা পেল। কিন্তু একা আর কয়জনের সাথে লড়বে! তার ওপরে অসুস্থ। একপর্যায়ে আর পারল না। বুকে কামড় খেয়ে ঢলে পড়ল। তারপরে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল। ঘণ্টা খানেকের ভেতরে সবাই মিলে ঘোড়াটাকে খেয়ে দেয়ে শেষ করে স্থানটিকে একেবারে সাফ সুতেরো করে ফেলল। মহাতৃপ্তির সাথে রাণী খেল হৃদপিণ্ডটা ।
রাজাবিহীন সুন্দরবনের বাসিন্দারা এবার মহাবিপাকে পড়ল। ওদিকে খোক্কসদের এবং তাদের চেলা চামুণ্ডা ও দালালদের সাহস বেড়ে গেল।
তারপর একদিন এল সেই অপ্রত্যাশিত ঘোষণা। সুন্দরবনকে ...... তারিখে ভয়াল বনের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যারা মানবে না তারা যেন সুন্দরবন ছেড়ে চলে যায়। অন্যথায় তাদেরকে মেরে খেয়ে ফেলা হবে।

* * * *

কোথায় যাবে তারা ? আদি পুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে কে যেতে চায় ? অতএব, মরতে হয় মরবে, কিন্তু কোথাও যাবে না । প্রয়োজনে লড়বে।
বনের সব গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়া-হরিণ একজোট হল। সাথে গুটিকয়েক ঘোড়া।
আহা! কি অদ্ভুত দৃশ্য! সব নিরীহ প্রাণীর দল। ওরা আজ জানবাজী করে অগ্রসর হচ্ছে ডাইনির আশ্রম গুড়িয়ে দিতে। কারণ এই আশ্রমটিই যতো নষ্টের মূল। এই কাজটি যদি আগেই করা হত, তবে এই বিপদ আসত না।

* * * *

আশ্রমে সবাই আতঙ্কে কাঁপছে। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন ডাইনি রাণী। তার ইঙ্গিতে একটি খোক্কস আর কয়েকটি কুকুর সন্ধির পতাকা নিয়ে ঘোড়া গরুর দলের নিকটে গেল। স্থির হল যে আগামিকাল উভয় পক্ষ বৈঠকে বসবে।

* * * *

নিঝুম রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু হাত দূরের জিনিসও দৃষ্টিগোচর হয় না।
বিশাল চারণভূমিতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে পালে পাল গরু, মহিষ ও অন্যান্যরা।
ওদিকে ডাইনি শিবিরে কেউ ঘুমায় নি। ডাইনির কড়া হুকুম সবাই যেন জেগে থাকে। কয়েক দিন আগে বেশ কিছু খোক্কসকে গোপনে আশ্রমে আনা হয়েছে। ওরা পুরোপুরি রণসাজে সজ্জিত।
ডাইনি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। বহু পড়া-শুনা থেকে স্মৃতির পাতায় ঝল ঝল করছে প্রিয় দুটো উক্তি। একটি হচ্ছে টিক্কা খান নামের এক নরপিশাচের কথা “ বাংলার মাটি চাই , মানুষ চাই না।” অন্যটি হচ্ছে স্তালিন নামের এক নর দানবের কথা “ Death solves all problems – no man, no problem.” অতএব, সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হল না। মানুষরা যদি নৃশংস হতে পারে, তবে ডাইনিরা কেন পারবে না ?
ডাইনির ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে সুন্দরবনের ঘুমন্ত বাসিন্দাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ডাইনির বাহিনী।

আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠল আর্তনাদ, কোঁকানি আর গোঙানিতে। তারপরে এক সময় সব নিথর হয়ে গেল। রাতের আসমান নিরবে দেখল যে একটি জমিন কেমন করে সিক্ত হল অসহায় আর দুর্বলের রক্তে।
প্রতিদিনের মত সকাল বেলা সূর্য তার কিরণ ঢালল, তবে লাশের পাহাড়ের ওপর।
খবর পেয়ে ভয়াল বন থেকে এল রাক্ষস থেকে হোক্কস , সবাই দলে দলে। শুরু হল ভোজন উৎসব। তা চলল এক নাগাড়ে দশ দিন। হাড়-মাংস-চামড়া শুদ্ধ সাফ হয়ে গেল। এখন কেউ বলবে না যে একদা এই বনে পাল পাল গরু মহিষ ইত্যাদি ছিল। সেখানে এখন গায়ের লোম দাঁড় করানো নির্জনতা।

* * * *

বনের পাখীরা ছিল ঘটনার নীরব দর্শক। সুন্দরবনের বাসিন্দারা ছিল ওদের দীর্ঘ দিনের বন্ধু। ওরা আজ নেই। তাই তারাও এই বন ছেড়ে অনেক অনেক দূরে কোথাও চলে যাবে বলে মনস্থির করল। তবে যাবার আগে শূন্য বিরান ভূমিতে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করে গেল। উহাতে লেখা হলঃ
তারিখঃ .........
একটি কাল রাত।

এই রাতে সাম্রাজবাদী শক্তি বিশ্বাসঘাতকতা আর নির্মমতার মাধ্যমে সুন্দরবনকে গ্রাস করে নেয় । সুন্দরবনের বাসিন্দারা ছিল সহজ, সরল । কিন্তু তারা সময় থাকতে হুঁশিয়ার হয়নি। সেই বোকামির খেসারত দিল সমূলে উচ্ছেদ হয়ে গিয়ে। পৃথিবী বড়ই নিষ্ঠুর! এখানে সর্বদা সদিচ্ছার জয় হয় না। কারণ সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। এজন্য ইচ্ছা থাকলেই সর্বদা উপায় বের হয় না।

* * * *

: দেখলে তো! বলেছিলাম না আমি পারব ? স্বামী রাক্ষস রাজার দিকে তাকিয়ে ডাইনি রানীর প্রশ্ন।
: সত্যিই এটা অবিশ্বাস্য! বিন্দুমাত্র লোকবল ক্ষয় না করে এমন করে দেশজয়! ব্রিটিশরাও তো পারে নি এমন সাফল্য দেখাতে যদিও তারা মীরজাফরকে কিনে নিয়েছিল।
: আসলে অনেক বীভৎস কাজই সম্ভব যদি জায়গামত শঠতা, ধূর্তামি আর নিষ্ঠুরতা ইত্যাদির আশ্রয় নেয়া হয়। আমরা এমনটি আরো করব। এভাবে পৃথিবী থেকে সব অসহায় দুর্বলদেরকে নির্মূল করে দেব। এ জগতে বাস করবে কেবল শক্তিমানরা মানে রাক্ষসরা।
হাঃ হাঃ .........হাউ মাউ খাউ ......।
প্রাণ খুলে হাসতে শুরু করল রাক্ষস রাজা ।
সে হাসিতে যোগ দিল ডাইনি রাণীও ।

* * * *

আনুষ্ঠানিকভাবে সুন্দরবনকে ভয়াল বনের অন্তর্ভুক্ত করা হল। এ উপলক্ষে দেশব্যাপী আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হল। সবচে বড় উৎসবটিতে এক বিশেষ নৃত্য সভার ব্যবস্থা করা হল যেখানে স্বয়ং রাণী নৃত্য পরিবেশন করবেন।

* * * *

উৎসবের দিন।
ঘোষকের ঘোষণা শেষ ।
রুদ্ধ শ্বাসে অপেক্ষমাণ ভয়াল বনের বাসিন্দারা। রানীকে দেখবে।
ধীরে ধীরে পর্দা উঠলো।
ডাইনি রাণী দাঁড়িয়ে আছে ভীতি জাগানিয়া সাজে।
রাজা হাততালি দিলেন।
শুরু হল রানীর নাচ। যে নাচের ছন্দে ছন্দে ফুটে ওঠছে অন্তরের যাবতীয় অশুচি, হিংসা আর হিংস্রতা।
রানীর নাচ আবেগ সঞ্চার করল রাজার মধ্যে। হার্টের অপারেশন ভুলে রাজা গান ধরলেন।
এবারে দর্শকরাও আর বসে থাকতে পারল না। তারাও তালে তালে লাফাতে লাগল।
রাক্ষস রাজা গাইছেন। যেন আষাঢ়ের মেঘ ডাকছে।
ডাইনি রাণী নাচছে। মেদিনী কাঁপছে।
শত সহস্র রাক্ষস, খোক্কস, বোক্কস আর হোক্কস উন্মত্ত উল্লাসে নর্তন-কুর্দন করছে, পৈশাচিক সুরে চেল্লাচ্ছে।
হাউ মাউ খাউ ......ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই বুঝা যায় না।
অফ ! ভয়ংকর সেই দৃশ্য !!
যে না দেখেছে, সে না বুঝেছে।
কখন শেষ হবে ?
কেউ জানে না।


লেখক:
সহকারী অধ্যাপক
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি, ঢাকা ১২০৭  
ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.bd

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, ২৩ জুলাই, ২০১৩ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন