-->

০২-০৩-৭১

আজাদের চোখে ঘুম নেই। রজনী গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। অথচ আজাদ বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে, থেকে থেকে উঠে বসছে, আবার শুয়ে পড়ছে। কেন? কিসের জন্য? আজাদ কিছুই বুঝতে পারছে না। কেবল হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা টর্নেডোর আভাস পাচ্ছে। এ যেন এক প্রলয়ঙ্কারী সাইক্লোন, সব কিছু ভেঙ্গে-চুরে চুরমার করে দেবে । কিন্তু কী করে সম্ভব! আজাদ মাত্র কৈশোরে পদার্পণ করেছে, বয়স এখনো তেরো হয়নি।
আগামীকাল যেন কয় তারিখ? ২রা মার্চ, ১৯৭১ সাল। মিছিলে যেতে হবে।  যেমন করেই হোক, যেভাবেই হোক।
: কি রে, বাবা! ঘুম থেকে উঠবি না?
মায়ের ডাকে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বিছানায় উঠে বসলো আজাদ। টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকালো। সাড়ে  আটটার মতো বাজে। শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। অনেক রাত করে ঘুমানোর জের। মিছিল কি শুরু হয়ে গেছে? প্রশ্নটা মনে জাগতেই সব অলসতা নিমিষে উড়ে গেল। ঝটপট হাত মুখ-ধুয়ে নাস্তা খেতে বসলো।

মা পিঠা বানিয়েছে। ভাঁপা পিঠা। আজাদের খুব পছন্দের পিঠা। অন্যান্য সময়ের তুলনায় দুটো পিঠা বেশিই খাবে বলে মনস্থির করলো। সারাদিন মিছিল করতে হবে। অনেক অনেক শক্তির দরকার!
: অত তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছিস কেন? গলায় বিঁধবে তো।
মায়ের কথায় আজাদের সম্বিত ফিরে আসে। খাওয়ার গতি কমায়। অন্য সময় হলে আয়েশ করে ধীরে সুস্থে খেতে পারতো। কিন্তু আজ সেই মনই নেই। সারাক্ষণ উথাল পাতাল অবস্থা।
আচ্ছা! মা-কে কি বলে যাবে ? মাথা খারাপ! মা জানলে তালা দিয়ে ঘরে আটকে দেবে। আর আজাদের মনের অবস্থা এমন যে মায়ের নিষেধ অমান্য করে হলেও যাবে। অথচ আজাদের স্মরণ পড়ে না যে কখনো মায়ের অবাধ্য হয়েছে কি না। আবার মায়ের হুকুম অমান্য করে গেলে অমঙ্গল হবে। অতএব, কে যায় ঝামেলা করতে? মিছিল থেকে ফিরতে দেরি হলে পরে মায়ের কাছে মাফ চেয়ে নিলেই হবে।
বাবা বাসায় নেই। তুহিন ও মিলিকে সাথে নিয়ে গত পরশু গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। ফিরবে আরো দু’দিন পর। হুসাইন, সবচে ছোট্ট ভাইটা, এখনো ঘুমাচ্ছে। বাবা থাকলে খুব ভালো হত। বাবার চেহারা দেখলেই সাহস বাড়ে। মা বলেন, ‘ তোর বাবার মতো সাহসী মানুষ গোটা দেশে আর একজন নেই।’ বাবা থাকলে নিশ্চয় মিছিলে যেতেন। তবে তাকে কি নিতেন ? মনে হয় না। বাবারা বড় অদ্ভুত! নিজেরা করবেন, অথচ ছেলেদেরকে করতে দেবেন না।
‘জয় বাংলা’...
স্লোগানের শব্দ কানে আসতেই আজাদের চিন্তাজাল ছিঁড়ে যায়। বহুত দূর থেকে আসছে, খুবই ক্ষীণ শব্দ। কিন্তু আজাদের উৎকণ্ঠিত কানে তা এড়ায় না। আর দেরি করা যায় না। এক ঢোকে গ্লাসটি খালি করে দরজার চৌকাঠে এসে দাঁড়ায় আজাদ।
: মা, একটু বাইরে যাই।
: বেশী দূরে যাসনে বাবা। দেশের অবস্থা ভালো না।
: আচ্ছা। চিন্তা করো না, মা।
ধীর পায়ে ঘর থেকে বাইরে আসে আজাদ। তারপর মায়ের চোখের আড়াল হতেই এক দৌড়ে চৌরাস্তার মাথায়। মিছিল আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে অতিক্রম করে সামনে চলে যাবে। তখন সে-ও মিছিলে ঢুকে যাবে। আজাদের রক্তে বান ডাকছে। স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। হঠাৎ খেয়ালে আসলো যে, সে তো এক্কেবারে নিধিরাম সর্দার। ঢাল তলোয়ার কিছুই তো নেই। আত্মরক্ষার জন্য কিছু একটা থাকা দরকার। গুলতিটা থাকলেও মনে বেশ বল পেত। গুলতি ছোঁড়াতে সে খুব পারদর্শী। পাড়ার প্রতিযোগিতায় ফি-বছর প্রথম হয়। তাড়াহুড়োয় বাসায় রয়ে গেছে। এখন আর আনার সময় নেই। এদিক-ওদিক তাকালো আজাদ। অনেকগুলো মাটির ঢেলা পড়ে আছে। শক্ত দেখে কুড়োতে শুরু করলো। আজাদ পাঞ্জাবীর পকেট ভর্তি করে নিল।
‘তোমার আমার ঠিকানা; পদ্মা মেঘনা যমুনা।’
আহ! কি হৃদয়গ্রাহী স্লোগান ! আজাদ মিছিলে মিশে গেল। মনে হল, পৃথিবীতে জন্ম নেয়াটা বুঝি এতদিনে স্বার্থক হলো। স্কুল খুললে সব্বাইকে বলা যাবে। এত আনন্দ এই  জীবনে আর কক্ষনো পেয়েছে বলে মনে পড়ে না। তাই গলার সবটুকু শক্তি দিয়ে সবার সাথে তাল মিলিয়ে স্লোগান দিতে লাগলো।

মিছিলটা হটাৎ দাঁড়িয়ে গেল। ব্যাপার কী। তৃতীয় কাতারে আজাদের অবস্থান। সেখান থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। ফার্মগেট থেকে পাক (বর্তমানে বাংলা) মোটর যাবার যে রাস্তা, সেখানে অনেকগুলো পাকিস্তানী সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে। হাতের বামদিকে পাশাপাশি দুটো ব্যাংক— হাবীব ব্যাংক ও ইউনাইটেড ব্যাংক (বর্তমানে অন্য  নাম )। ব্যাংক  দুটোর মাঝখানে সরু একটি গলি। মিছিল ছেড়ে গুটি কয়েক মানুষ ওই গলিপথে সরে পড়ছে। এতো ভীত ওরা!
মিছিলে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, ওদের সাথে সৈন্যদের তর্ক বেঁধেছে। আজাদ পুরোপুরি বোঝে না। সৈন্যগুলো উর্দু বলছে। সৈন্য নয়, খাস শয়তান। আজাদ মনে মনে ভাবে। নচেৎ নিজ দেশের লোকের সাথে কেউ এমন আচরণ করে?
তর্কাতর্কি চরম আকার ধারণ করেছে। কোনো বাধাই বুঝি আজ মানা হবে না। নেতারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে সবাইকে শান্ত রাখতে। আ-রে ও কি? ইয়া বড় গোঁফওয়ালা সর্দার গোফেঁর সেপাইটা অস্ত্র ওঠাচ্ছে কী উদ্দেশ্যে? মুহূর্তের মধ্যে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে লাগলো। কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ সামনে এগুচ্ছে। ওদিকে সৈন্যরা এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ছে। রাজপথ রক্তে লাল হয়ে যায়। নিরস্ত্র জনতার উপর চলছে সশস্ত্র সৈন্যদের বিরামহীন গুলিবর্ষণ। চার হাত দূরে মহল্লার মুসলিম চাচাকে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখলো। জানে বাঁচতে হলে আপাতত পালাতে হবে। কিন্তু একটি প্রতিঘাতও কি করা হবে না? এক মুহূর্তে কর্তব্য ঠিক করে নিয়ে আজাদ পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢোকায়। নিখুঁত নিশানায় ছোড়া ঢেলাটি একজন সৈনিকের বুকে লাগে। সৈনিকটিকে দেখলো ব্যথায় কুঁকড়ে যেতে। আজাদ উল্লসিত।  দ্বিতীয় ঢেলাটি ছোঁড়ে। এটিও একজনের গায়ে লাগে। আজাদ রোমাঞ্চিত! ভুলে যায় স্থান-কাল-পাত্র। আবার পকেটে হাত দেয়। কিন্তু হাত বের হয় না। কিসের ধাক্কায় মাটিতে বসে পড়ে। জামা কাপড় সব গরম কিছুতে ভিজে যাচ্ছে। আজাদের ঘোর কেটে যায়। বুঝতে পারে গুলি খেয়েছে, বুকে। হায়, আজ-ই বুঝি জীবনের শেষ দিন! মার কাছে, বাবার কাছে মাফ চাওয়া হয় নি। কী মনে হতেই সে প্রাণপণে উঠে দাঁড়ায়। টলতে টলতে এসে দাঁড়ায় হাবীব ব্যাংকের সামনে। আজাদের মধ্যে যেন অপার্থিব শক্তি ভর করেছে। বুকে হাত দেয়। তাজা রক্ত। রক্তে রঞ্জিত হাতটি ব্যাংকের দেয়ালে বুলায়; বার বার। রক্ত দিয়ে আঁকাবাঁকাভাবে লেখা হয় ‘০২-০৩-৭১’ ; নিজের নামটা এবার লিখতে হবে। হাতটা রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে, ভীষণ ভারী। আর উপরে উঠলো না। আজাদের দু’চোখে আঁধার আর আঁধার ঘনিয়ে এলো। ঢলে পড়লো ব্যাংকের বারান্দায়। দেহ পিঞ্জিরা ছেড়ে আজাদের রূহ চলে গেল তার স্রষ্টার সমীপে। আজাদ চিরকালের জন্য আজাদ হয়ে গেল পাকিস্তান হতে, এমনকি এই নশ্বর পৃথিবী থেকেও।

[০২-০৩-১৯৭১। ঢাকার ফার্মগেটে পাকিস্তানী সৈন্যরা মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালালে বেশ কিছু লোক হতাহত হয়। ১২-১৩ বছরের আহত একটি বালক মৃত্যুর আগে নিজের রক্ত দিয়ে হাবীব ব্যাংকের দেয়ালে ০২-০৩-৭১ লিখে রেখে যায়। সেদিন বিকালে আমি স্বচক্ষে এই লেখাটি দেখি। এটি অনেকদিন (১৯৭২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত) ছিলো। ঘটনার সময়ে আমার বয়স ৯ ছুঁই ছুঁই। ঘটনাটি আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিলো। কতজনকে যে এই লেখার কথা বলেছি তার হিসাব নেই। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের নাম না জানা হাজার শহীদের মতো ওই বালকটি সম্পর্কেও আর কোনো তথ্য যোগাড় করতে পারি নি।]

মোহাম্মদ সালেক পারভেজ
সহকারী  অধ্যাপক
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি, ঢাকা ১২০৭  
ই-মেইল: sparvez@daffodilvarsity.edu.bd

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, ২৫ মার্চ ২০১৩

প্রথম প্রকাশঃ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
http://ebanglanews24.com/Bangla/detailsnews.php?nssl=c54671f7946cd78eddd515881e1acc27&nttl=25032013184171

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন