( পর্ব ১ ) :
সে অনেক অনেক
দিন পরের কথা ।
ডক্টর আখদায়ুল
কাজ্জাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের এক ডাক সাইটে অধ্যাপক। ‘Kajjab’s Conjecture’ আর
বিজ্ঞানী ‘হকিঙ-এর অসমাধিত কর্মের সমাধান’ এই দুটো বিষয় ভদ্রলোককে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে। তবে ভদ্রলোক
কেবল বিজ্ঞানের নিরস শিক্ষক নন; দেশের নানা সমস্যা নিয়ে তিনি প্রচুর মাথা ঘামান, লেখালেখি
করেন, দিকনির্দেশনাও দিয়ে থাকেন। ‘ভুতের মুখে কেন রাম নাম’ ও ‘0 + 0 ≠ 0’ বই দুটো তাকে সর্বসাধারণ মহলে পরিচিত করেছে।
এ কারণে দেশের ভিতরে-বাহিরে ভক্তের অভাব
নেই তার। রাস্তায় বের হলে সালাম আর সম্ভাষণের জবাব দিতে দিতে ভদ্রলোক ক্লান্ত হয়ে
পড়েন। অথচ এই বিশ্ববিখ্যাত ডক্টর সাহেবের ইদানীং বেশ কিছু রাত ধরে ঠিকমত ঘূম হচ্ছে না। প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় দিন আর রাত গুলো পার করছেন।
অবশ্য এই যন্ত্রণার কারণ না পারিবারিক, না পেশা
সংক্রান্ত। দীর্ঘদিন ধরে তিনি উপলব্ধি করে আসছেন যে, সমাজে একটি বড় ধরণের
পরিবর্তন দরকার। আর সেই পরিবর্তনটা হতে হবে মানুষের চিন্তায়-চেতনায় ও কর্মে। ‘
বদলে যাও, বদলে দাও’ স্লোগানটা সেই শিশুকাল থেকে শুনে আসছেন। কিন্তু বদলাল আর কৈ ?
কিন্তু মৌলিকভাবে কি পরিবর্তনটা দরকার ? এটা ভাবতে ভাবতেই ভদ্রলোকের ঘুম গেছে
গোল্লায়। রাত দিন এটা সেটা পড়ছেন, ভাবছেন আর কাপের পর কাপ কফি পান করছেন। কিন্তু
কোন সিদ্ধান্তে পৌছতে পারছেন না।
আজ
১লা জানুয়ারি অর্থাৎ নববর্ষ। কাল রাত থেকে শুরু হয়েছে হৈ হুল্লোড়, এখনও চলছে, চলবে মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাবের ঐদিকে এক বিন্দু
মনযোগ নেই। তিনি বসে আছেন ব্যক্তিগত ‘স্টাডি রুমে’। জিদ চেপে গেছে, আজই এই প্রজন্মের জন্য একটি
দিকনির্দেশনা তৈরি করতে হবে। কে জানে আগামী নববর্ষ পর্যন্ত বেঁচে নাও থাকতে পারেন।
দ্বিতীয় একজন ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাবের জন্য জাতিকে হয়তো কয়েক শত বৎসর অপেক্ষা করতে
হবে। কী যেন ভেবে বইগুলো দূরে ঠেলে দিয়ে পত্রিকার
আর্কাইভ ঘাঁটা শুরু করলেন। যদি কোথাও কোন ইঙ্গিত মেলে এই প্রত্যাশায়। ঘাঁটতে
ঘাঁটতেই একটি লেখার উপর নজর স্থির হয়ে গেল। অনেক অনেক দিন আগে, তৎকালীন বহুল প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকের ১৬/৮/২০১৩ তারিখের সংখ্যায় লেখাটি
প্রকাশিত হয়, লেখক ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ।
ডক্টর
আখদায়ুল কাজ্জাবের আদর্শ পুরুষ হলেন ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাব মনে করেন যে তার জীবনের
অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবালকে দেখতে পাওয়া। যদিও সেটা ঘটেছিল মাত্র
একবার এবং সেই পাঁচ বৎসর বয়সে। তেমন একটা মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে যে,
আদর্শ পুরুষের বেশ পরিপুষ্ট একটা গোঁফ ছিল। সেই স্মৃতি থেকে এবং
পরবর্তীকালে ছবি দেখে তিনি নিজেও ঐ ধরণের একটা গোঁফ রেখেছেন। তবে
তাকে মনে হয় খুব একটা মানায় নাই। শুনেছেন ছাত্র-ছাত্রীরা আড়ালে আবঢালে তার গোঁফকে ‘বিড়ালের লেজ’ বলে।
যাক
সে কথা! ক্ষণিকের নস্টালজিয়া থেকে ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাব বাস্তবে ফিরে এলেন। ‘মিথ্যা বলার অধিকার’ শিরোনামের লেখাটি গভীর মনযোগের সাথে
পড়লেন ; একবার নয়, বেশ কয়েকবার।
চিন্তা-সাগরে ঢেউ তোলার মত একটি লেখা। বিশেষ করে এই কথাগুলো, “গত কিছুদিনে আমি একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি।
একটি দেশের মানুষের যেরকম খাদ্য, বাসস্থান এবং শিক্ষার অধিকার থাকে, আমাদের দেশে তার সাথে একটা নতুন বিষয় যোগ হতে যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে মিথ্যা কথা বলার অধিকার। ...... এখন কী আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সেটাকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে হবে?” ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাব ইতিকর্তব্য ঠিক করে ফেললেন। তিনি নামবেন, এই কাজটিকে বাস্তবায়িত করবেন। ‘মিথ্যা বলার অধিকার’-কে আনুষ্ঠানিক রূপ দেবার জন্য উঠেপড়ে লাগবেন। হারিজিতি
নাহি লাজ, ধনুকভাঙ্গা পণ করেই তিনি মাঠে নামবেন। জীবন থাকতে ব্যর্থতা মেনে নেবেন না।
কারণ এটা করতে পারলে সবাই উপলব্ধি করতে পারবে যে, এই জাতি
আসলেই বদলে গেছে।
( পর্ব ২ ) :
।। পটভূমি ।।
ডক্টর
আখদায়ুল কাজ্জাব ‘মিথ্যা বলার অধিকার’ আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী আহবান জানিয়েছেন। যেহেতু সারাদেশে ডক্টর
সাহেবের ভক্ত-অনুরক্তের কোন অভাব নেই, এই আহবান অচিরেই একটি বিরাট আন্দোলনের রূপ
নিয়েছে । তারা সকলে জমায়েত হয়েছে ঐতিহাসিক শাহবাগ চত্বরে, কারণ ওখানে অনেকদিন আগে এক সফল
আন্দোলন হয়েছিল। ইতিহাস ঘেঁটে ঐ সফল আন্দোলনের প্রক্রিয়া পুনরায় প্রয়োগ করা হল।
ফলে আবার দেখা যেতে লাগল সেই লম্ফ-ঝম্ফ আর নর্তন-কুর্দন । দিবানিশি উচ্চারিত
হতে লাগল কান ফাটানো স্লোগান, “ ম- তে মিথ্যা, তোমার
জয় হোক”, “ স-তে সত্য, তুই বিদায়
হো ” ইত্যাদি। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে
আবার হুকুম জারী করা হয় দাঁড়িয়ে থাকার ( অবশ্য মাত্র ২ মিনিটের জন্য, সৌভাগ্যক্রমে ২ ঘণ্টার জন্য নয়
কিম্বা কান ধরেও নয় )। আস্তে আস্তে সরকার-প্রশাসন
সব এতে সংযুক্ত হয়। অতঃপর যথা পূর্বং তথা পরঙ । আন্দোলন কামিয়াব হয়। নতুন
আইন প্রবর্তিত হয়, “ এদেশে কেহ যেন সত্য না বলে,
কারণ Truth is no defense. সবাই
মিথ্যা বলবে। মিথ্যা বলা কোন অপরাধ নয়। যারা সত্য বলবে তাদেরকে প্রয়োজনে ......
ধারা মতে বিভিন্ন ধরণের শাস্তি প্রদান করা হবে। ”
সাড়া
দুনিয়ায় হৈ চৈ পড়ে গেল। তবে নিন্দুকের কথায় কান কে দেয় ? নতুন আইনের ফলে কথায় কথায় দেশে
উন্নতির অবিশ্বাস্য জোয়ার বর্ণিত হতে লাগল। আর এই নতুন আইনের প্রথম প্রস্তাবক
হিসাবে ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাব সাহেব নিত্য নতুন
পদকে ভূষিত হতে লাগলেন। অবশ্য প্রাচীনপন্থীরা
আড়ালে আবডালে ফোঁড়ন কাটে, “ অদ্ভুত এক উটের পিঠে চলছে স্বদেশ।”
এমন
পরিস্থিতিতেই ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাব যে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, উহাতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত
হল । তবে পরীক্ষার প্রশ্নে এবারে
ভিন্ন ধরণের একটি নির্দেশিকা থাকলঃ সঠিক উত্তরের
জন্য শূন্য নম্বর ; অর্ধ সঠিক উত্তরের জন্য অর্ধেক নম্বর ;
পরিপূর্ণ ভুল উত্তরের জন্য পূর্ণ নম্বর ;
তাক লাগানো মিথ্যা উত্তরের জন্য বোনাস নম্বর ।
( পর্ব ৩ ) :
।। দৃশ্য ১ ।।
ডক্টর
আখদায়ুল কাজ্জাব সাহেবের সামনের টেবিলের উপরে স্তূপীকৃত হয়ে আছে একগাদা ভর্তি
পরীক্ষার খাতা। ভর্তি পরীক্ষার খাতা দেখার মত ছোট-খাট কাজ তিনি অনেক আগেই
ছেড়ে দিয়েছেন। তবে এবারের কথা আলাদা । তার গুরুর প্রস্তাবিত ‘মিথ্যা বলার অধিকার’ দাবীটি আইনের আকারে পাস হওয়াতে সমাজে ব্যাপক
পরিবর্তন এসেছে বলে তিনি মনে করেন। লোকে তাকে যে ভাবেই জানুক, নিজকে তিনি সমাজ সংস্কারক হিসাবে ভাবতেই প্রীত বোধ করেন। এই কারণেই সমাজের
শ্বাশত ধারণার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন। সুখের বিষয় যে সফলতা পেয়ে গেছেন। এমন
এক কাজ করতে পেরেছেন যে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব ঠেকায় কে ? আত্মতৃপ্তির
ঢেঁকুর তুলে একটি খাতা টেনে নিয়ে দেখতে লাগলেন। ছোট ছোট প্রশ্ন এবং উত্তরগুলোও
সংক্ষেপে।
প্রঃ Law of Gravitation এর
আবিষ্কর্তা কে ?
উঃ ডঃ
মুহম্মদ জাফর ইকবাল ।
আদর্শ
পুরুষের নাম দেখে ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাব সাহেবের মনটা খুশীতে ভরে ওঠল।
প্রঃ
Theory of Relativity এর আবিষ্কর্তা কে ?
উঃ
ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ।
প্রঃ
Bing Bang Theory কার অবদান ?
উঃ
ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবালের ।
প্রঃ
Internet এর
জনক কে ?
উঃ
ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাব ।
রোমাঞ্চিত
হয়ে উঠলেন ডক্টর সাহেব । এই ছাত্রটিকে বোনাস নম্বর দিতেই হবে। আর ‘মিথ্যা বলার অধিকার’ আদায়ের এমনতরো সাফল্য তো ভুলেও কল্পনায় আসে নি । এমনকি তার মহামান্য গুরুও হয়তো ভাবতে
পারেন নি। ঠিক আছে, আগামীকালই সকল পুস্তক
প্রকাশকদের কাছে নোট পাঠাতে হবে, যেন জরুরী ভিত্তিতে
উপরের প্রশ্নোত্তর মোতাবেক সংশোধনী আনা হয়। দরকারে RAB – Police এর সাহায্য নিতে হবে। তিনি এখন দেশগুরু ; তার ইশারাই কাফী। তবে তার আগে
ঘনিষ্ঠ দু’এক জনকে ফোনে সুখবরটা জানান দরকার।
।। দৃশ্য ২ ।।
ভর্তি
পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসেছেন ইতিহাসের এক অধ্যাপক। উনি নামকরা ইতিহাসবিদ, এক নামে গোটা দেশের সকলে চেনে।
‘মোগল পাঠান হদ্দ হল’ নামক বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থটি তার রচনা। ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাব
সাহেবের সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা। ‘মিথ্যা বলার অধিকার’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একযোগে কাজ
করেছেন। সফলতা এসেছে। এখন তাই উল্লাসে অহংকারে পা যেন মাটিতে পড়ে না। যারা জীবনের সর্বক্ষেত্রে সত্য নিয়ে মাথা ঘামায়, ওদেরকে দেখলে তার হাসি পায়,
করুণা আসে। সে যাকগে, হাতের কাজটি তাড়াতাড়ি
শেষ করা দরকার। বিকালে দুইটি সেমিনার আছে। দু’জায়গাতেই তিনি প্রধান বক্তা। প্রথমটির বিষয়ঃ ‘ The Art of Telling Lies’ এবং দ্বিতীয়টির বিষয়ঃ ‘ঐতিহাসিক সত্যকে কিরূপে মিথ্যা বানাতে হয়’। প্রস্তুতির একটা ব্যাপার আছে তো । তাড়াতাড়ি বান্ডিল থেকে একটি খাতা টেনে নিয়ে মনযোগের সাথে
দেখতে লাগলেন।
প্রঃ
বাংলাদেশের রাজধানী কোথায় ?
উঃ
নোয়াখালী।
হেসে
দিলেন বিজ্ঞ ইতিহাসবিদ । ছোড়া যে কেবল মিথ্যায় দক্ষ তা নয়, রসিকও বটে।
প্রঃ
স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ কোন দেশের অংশ ছিল ?
উঃ
আমেরিকার।
দারুণ
! এ- কে ভর্তি করাতেই হবে। এরাই জাতির যোগ্য কাণ্ডারি হতে পারবে।
প্রঃ
বঙ্গবন্ধুকে কে হত্যা করে ?
উঃ কর্নেল তাহের ।
এটা
আবার কি লিখল ? পরক্ষণেই মনে পড়ল মিথ্যা লিখতেই হবে ! নচেৎ নম্বর মিলবে না !!
প্রঃ
স্বাধীনতার সময়ে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কে ছিল ?
উঃ
মেজর ডালিম ।
প্রঃ
১৯৭০ সালের নির্বাচনে কোন দল জয়ী হয় ?
উঃ
বিএনপি ।
প্রঃ স্বাধীনতা যুদ্ধে কত লোক
শহীদ হয়েছে ?
উঃ
একজনও নয়।
তথ্যগুলো
হজম করতে ইতিহাসবিদের বড্ড কষ্ট হচ্ছে । সারাজীবন তিনি শুনে এসেছেন, সত্য নাকি তিক্ত হয়! কিন্তু
আজ যে মিথ্যার স্বাদও তেঁতো মনে হচ্ছে। এমন কি প্রেশারটাও
বেড়ে যাচ্ছে। যাক, আর একটু এগোই। দেখি, বেটা কি লিখেছে !
প্রঃ
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কে প্রদান করেন ?
উঃ
মাওলানা দেলোয়ার হসাইন সাঈদী ।
প্রঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক কে ?
উঃ
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী।
প্রঃ
বাংলাদেশের জাতির জনক কে ?
উঃ
অধ্যাপক গোলাম আযম।
এবারে
ইতিহাসবিদ আর সামলাতে পারলেন না। মাথাটা ঘুরে যাওয়াতে ধপাস করে চেয়ার থেকে পড়েই
গেলেন।
ক্রিং
ক্রিং ...... ফোনটা বাজছে। কোনমতে তুলে ধরলেন।
:
হ্যালো ...... কে ?
:
ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাব বলছি ।
:
সরি ছ্যার, আমি খুব অসুস্থ। মাথাটা ঘুরছে। একটু আগে আবার চেয়ার থেকে পড়ে মাঝায় ভীষণ
ব্যথা পেয়েছি । পরে কথা বলব।
লাইন
কেটে দিলেন হতভম্ব হয়ে যাওয়া ইতিহাসবিদ । মনে হচ্ছে যে, চেয়ার থেকে নয়, বরং আকাশ থেকে পড়েছেন । বড্ড ভুল হয়ে গেছে ! আন্দোলনের ফলাফল পুরোপুরি বুমেরাং হয়ে
গেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ রকম করেই ভাববে এবং বলবে । কেন যে বেওকুফটার পাল্লায় পড়ে
আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন ! এখন আর নিস্তারের উপায় নেই । দীর্ঘশ্বাস চেপে অনেক কষ্টে
একটা হাঁক ছাড়লেন।
:
এই, কে আছিস রে
! একটা গ্লাস ......দে তো ।
( শেষ পর্ব ) :
।। দৃশ্য ৩ ।।
অন্য
একজন অধ্যাপকের স্টাডি রুম। ভদ্রলোক দাঁড়ি-টুপী, পায়জামা-পাঞ্জাবী ওয়ালা। দেখলে
মনে হয় মাদ্রাসার কোন হুজুর। আগাগোড়া ‘মিথ্যা বলার অধিকার’ আন্দোলনের সর্বাত্মক বিরোধিতা করে এসেছেন। এখন হারু দলের সদস্য
হয়ে একেবারে চুপ মেরে গেছেন । তবে নিজের মনকে কিছুতেই বুঝ দিতে পারছেন না । আনমনে
ভাবেন, একেই বলে কলির যুগ ! এর ফল যে কোথায় যাবে, জাতি একদিন টের পাবে।
অধ্যাপক
সাহেব দীর্ঘশ্বাস
ছাড়তে ছাড়তে স্তূপ থেকে ভর্তি পরীক্ষার একটি খাতা টেনে
নিলেন । হাতের কাজটা সেরে ফেলা যাক। গভীর মনযোগ সহকারে প্রশ্নোত্তর দেখা শুরু করলেন।
বিষয়ঃ সাধারণ জ্ঞান।
প্রঃ
প্রথম চাঁদে অবতরণকারী মানুষটির নাম কি ?
উঃ
মাসুদ রানা।
ছোড়াটা বোধ হয় রহস্য উপন্যাসের
খুব ভক্ত। তাই কল্পনার নায়ককে বাস্তবে নিয়ে এসেছে। কিন্তু মুশকিল হল, মিথ্যা উত্তরের জন্য নম্বর কাটা যাবে না। কি আর করা !
প্রঃ
‘দুষ্ট ছেলের দল’ বইটি কে লিখেছে ?
উঃ
আদিলুর রহমান ।
প্রঃ
‘নন্দিত নরকে’ বইটির লেখকের নাম কি ?
উঃ
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ।
প্রঃ
বাংলাদেশের কোন নাগরিক শান্তিতে ‘নোবেল পুরষ্কার’ অর্জন করেন ?
উঃ
কালা জাহাঙ্গীর ।
প্রঃ
আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা কে ?
উঃ
ডঃ আখদায়ুল কাজ্জাব ।
প্রঃ
‘পদ্মা সেতু’ দুর্নীতির নায়ক কে ?
উঃ
কামাল হোসেন ।
প্রঃ
‘ হলমার্ক ’ কেলেঙ্কারী কে করেছে ?
উঃ ডঃ মুহম্মদ ইউনুস ।
প্রঃ
‘ শেয়ার বাজারে ’ জড়িত দরবেশের প্রকৃত নাম
কি ?
উঃ বিল গেটস ।
প্রঃ
দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ও বহুল আলোচিত ‘মিথ্যা বলার অধিকার’
শীর্ষক প্রবন্ধের লেখক কে ?
উঃ
সাকা চৌধুরী ।
প্রঃ
বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নায়িকা কাকে ধরা হয় ?
উঃ
হুসাইন মুহম্মদ এরশাদকে ।
অধ্যাপক
সাহেবের পক্ষে আর এগোন সম্ভব হল না । খাতাটি বন্ধ করে খানিকক্ষণ
ভাবলেন। তারপর খাতাটা বড় একটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। আগামিকাল ডক্টর আখদায়ুল কাজ্জাবকে দেখতে দেবেন । সবচে ভাল হত যদি ডঃ কাজ্জাবের মানস গুরু ডঃ মুহম্মদ জাফর
ইকবালকে সরাসরি দিতে পারলে । কিন্তু উনি অনেক ওপরের পর্যায়ে চলে গেছেন, নাগালের বহুত বাহিরে ।
।। দৃশ্য ৪ ।।
পরদিন ।
সালাম-কালাম বাদে অধ্যাপক সাহেব
ডঃ আখদায়ুল কাজ্জাব সাহেবের হাতে প্যাকেটটা দিলেন । ভ্রূ কুঁচকে ডক্টর সাহেব
প্যাকেট খুলে খাতাটি বের করে উহাতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করলেন। ওটা শেষ করতে
না করতেই ইতিহাসবিদ বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে হাজির হলেন, হাতে
সেই খাতাটি। ডঃ আখদায়ুল কাজ্জাব সাহেব গভীর মনযোগের সাথে এটাও পড়লেন ।
: Sir ! তারপর ? তারপরে আর কি আশা করতে পারি ? উৎকণ্ঠিত স্বরে প্রশ্ন করলেন ইতিহাসবিদ ।
ডঃ আখদায়ুল কাজ্জাব সাহেব কোন
জবাব দিলেন না । উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকলেন খাতার উত্তরগুলো এবং সামনে
উপবিষ্ট অধ্যাপকদ্বয়কে । ভাবছেন, আমার এখন করার কিছুই নেই।
ধনুকের ছিলায় টঙ্কার তুলে যে তীরটি বের হয়ে গেছে, উহাকে কি
আর ফেরানো যায় ? যায় না, কস্মিনকালেও
না ।
এমন এক জটিল মুহূর্তে বেরসিকের মত
বাজতে শুরু করল ডঃ আখদায়ুল কাজ্জাবের মুঠোফোনটি । ওতে সেট করা রিং টোনটি উপস্থিত
সকলের অনেকবার শোনা আছে। এদ্দিন যাবৎ এটা ছিল এক
রোমান্টিক গানের কলি, তবে আজ যেন কলিটি অন্য কিছু
বলছে, “ তা-র আর প-র নেই, নেই কোন ঠিকানা । ......”
: সমাপ্ত :
বিঃ দ্রঃ কারো নাম যদি সত্যি সত্যি
আখদায়ুল কাজ্জাব হয়ে থাকে তার নিকট আমি ক্ষমাপ্রার্থী । বিষয়বস্তুর রস
আস্বাদনের জন্য নামটি উপযুক্ত মনে করে ব্যবহার করেছি।
লেখকঃ
মোহাম্মদ সালেক পারভেজ
সহকারী অধ্যাপক
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি , ঢাকা ১২০৭
ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.bd
১ম প্রকাশঃ ১২ জানুয়ারী ২০১৪, ১২:১১ অপরাহ্ন ; BreakingNews.com.bd ওয়েবসাইটে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিতঃ লেখাগুলো দেখার জন্য নিচের লিঙ্কগুলোতে ক্লিক করুনঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন